রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় বাস


হেডলাইটের একটি নেই, অন্যটি ঝুলছে। সিগন্যাল লাইটের সবগুলোই ভাঙা। বডির রং উঠে গেছে অনেক আগে। আসন-জানালা ভাঙাও। সাইনবোর্ড থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনাবিল পরিবহন নামে এমন কিছু গাড়ি। শুধু অনাবিল নয়, রাজধানীজুড়ে আরও অনেক কোম্পানির ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। বেশিরভাগের উঠে গেছে রং, নেই লুকিং গ্লাস। পেছনের গ্লাসও ভাঙা, ধুলা-ময়লা যেন নিত্যসঙ্গী আসনগুলোর। যাত্রীরা বলছেন, রাজধানী শহরে কোনোভাবেই চলতে পারে না এসব বাস। রংচটা, ভাঙাচোরা বাসের ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ চান বিশেষজ্ঞরা। বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন না হলে এসব বাস চলবে বলেই জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ মনে করে, দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ৫ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৩০ শতাংশ রাস্তায় চলাচল করে না। আর ৭০ শতাংশ রাস্তায় চলাচল করছে, যা দেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তায় বড় সংকট তৈরি করছে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ। তবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন তারা রাস্তায় পেলে জব্দ করে ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। ঢাকা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের মতে, শুধু রাজধানীর সড়কে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হলে ১০০ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন। অথচ তাদের অধীনে আছেন মাত্র পাঁচ-ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট। তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে চলাচলকারী যাত্রী তৌহিদুল আলমের সঙ্গে কথা হয়। প্রতিদিনের চলার পথের বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সড়কে চলা গাড়ির মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি ফিটনেসবিহীন। গাড়ির সিটকভার নেই। বিপজ্জনকভাবে লোহা ভেঙে বেরিয়ে থাকে, যা থেকে মানুষের হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে যায়। সিটে বসতেই ধুলোর ঝড় এসে নাকে-মুখে, শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ গাড়ির জানালার কাচ ভাঙা বা কাচ নেই। বৃষ্টি এলে ভিজতে হয়, রোদে পুড়ে চলতে হয়। সড়কে চলতে গিয়ে মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হয়। বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নারী, রোগীসহ বৃদ্ধ অসহায় মানুষকে। অনেক গাড়ির সিটে ছিঁড়া কাঁথা বেঁধে রাখাসহ ভাঙা গাড়ির এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখা যায়। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় যেসব তথ্য উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম তথ্য হলো, দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ সিটি সার্ভিস শ্রমিকদের মতে তাদের বাস সার্ভিস অতিরিক্ত ভাড়া নেয়। ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ আন্তঃজেলা বাস শ্রমিকদের মতে, তাদের বাস অতিরিক্ত ভাড়া নেয়। ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক বলছে, তাদের কোম্পানি ভাড়ার বিপরীতে কোনো টিকিট দেয় না। ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ আন্তঃজেলা বাস কোম্পানিতে টিকিট বাতিল ও মূল্য ফেরতের কোনো নীতিমালা নেই। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, সিটি সার্ভিসের ৮৯ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিকদের মতে, তাদের কোম্পানির বাস নিয়ম অনুযায়ী বাসের টায়ার, ইঞ্জিন ওয়েল, ব্রেক সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে না। ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ সিটি বাস সার্ভিসের কর্মীদের মতে, মূল নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরও তুলে ধরা হয়, ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী বাসযাত্রী যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন। ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী সহযাত্রী দ্বারা, ৬৪ দশমিক ৩ হেলপার দ্বারা, ৪০ দশমিক ৬ কন্ডাক্টর দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, পরিবহন শ্রমিকদের খারাপ আচরণ বা যৌন হয়রানির শিকার হলে ৯২ দশমিক ৯ শতাংশ যাত্রী কোনো অভিযোগ করেননি। ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ যাত্রী বলছেন, অভিযোগ জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। জানা গেছে, রাজধানীতে চলাচলরত সাড়ে তিন হাজার বাসের মধ্যে দুই হাজারের বেশির এমন দুর্দশা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো হলো গাবতলী-সায়েদাবাদ রুটের ৮ নম্বর মিনিবাস, মোহাম্মদপুরের মেশকাত পরিবহন, দিশারী পরিবহন, ইউনাইটেড পরিবহন, মতিঝিল-গাজীপুরের গাজীপুর পরিবহন, তানজিল পরিবহন, মিরপুর সার্ভিস, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট, এটিসিএল, তরঙ্গ পরিবহন, মিডওয়ে, আজিমপুরের ভিআইপি পরিবহন, মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটের নিউভিশন পরিবহন, যাত্রাবাড়ী-টঙ্গীর তুরাগ পরিবহন, ছালছাবিল পরিবহন, অনাবিল পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি। বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কোম্পানির বাসের বেশিরভাগই ‘জ’ সিরিয়ালের। এগুলোর বয়স ১৫ বছর বেশি। পরিবহন মালিক সমিতির হিসাব মতে, রাজধানীর ২৯০টির বেশি রুটে চলা করা প্রায় ৬ হাজার বাসের বেশিরভাগই রংচটা। অনেক বাসের মেয়াদ শেষ হলেও বন্ধ হয়নি যাত্রী পরিবহন। এর মধ্যে সহস্রাধিক বাস ২০ বছরের পুরোনো। সেগুলোকে রাজধানীতে চলাচলের জন্য আর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। তবে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রুট পারমিট ছাড়াই নির্দিষ্ট রুটে যাত্রী বহন করে চলেছে সেগুলো। যাত্রীবাহী এসব বাস যে কেউ দেখলেই বুঝবে এগুলোর ফিটনেস নেই। জেনেশুনেই বাধ্য হয়ে যাত্রীদের এসব বাসে চড়তে হচ্ছে। ওয়েলকাম ও মৌমিতা বাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কালু শেখ বলেন, সড়কে এমন যানবাহন থাকলে তা নিষিদ্ধের দায়িত্ব বিআরটিএর। ৩৬ সিটের জায়গায় যদি ৪২ করে থাকে তাহলে হয়তো আইনের অজান্তে এটি করে। তবে বাস রাস্তায় নামলে মামলা কিন্তু দিচ্ছে পুলিশ। একই বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, কর্তৃপক্ষকে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা করতে হলে সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলা জরুরি। পরিবহন মালিক থেকে শ্রমিক ও সড়ক ব্যবহারকারী সবাইকে সচেতন হয়ে ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলমান রয়েছে। রংচটা ও ভাঙাচোরা বাসগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করতে মালিকদের ৪০ দিনের সময়সীমা দিয়ে চলতি বছরের শুরুতে একটি গণবিজ্ঞপ্তি দেয় বিআরটিএ। অথচ সেই সময় অতিক্রম করার পরও রাজধানীতে দেদার চলছে লক্কড়ঝক্কড় বাস। এতে প্রায় সড়কে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এরই মধ্যে গত ১ জুলাই থেকে ত্রুটিপূর্ণ মোটরযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বুয়েটের এআরআইর পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, চোখে দেখে ফিটনেস নির্ণয় না করে অটোমেশনের মাধ্যমে তা দেখা প্রয়োজন। এতে করে নকশা বদলানোর বিষয়টি ধরা সম্ভব। একজন মানুষ পাঁচ মিনিটে অনেক গাড়ি দেখছে। এ নিয়ম আসলে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। জানা গেছে, রাজধানীতে চলাচলরত রংচটা ও ভাঙাচোরা যানবাহনের প্রকৃত হিসাব বিআরটিএতে নেই। অভিযান শুরুর পর ফিটনেস করানো এবং অভিযানে আটক গাড়ির সংখ্যা হিসাব করলে এ সংখ্যা প্রায় এক লাখ হবে। ঢাকা শহরে ৮০ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মালিকপক্ষ সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বাঁকা পথে ব্যবসা করছে। যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। এসব বন্ধ করতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়া দরকার।