ঋণগ্রস্ত হাবিব এমপি হয়েই হাজার কোটির মালিক


পুলিশ কর্মকর্তা থেকে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন আলহাজ হাবিবর রহমান। পরপর তিনবার তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর রাতারাতি কোটিপতি বনে যান সাবেক এসপি হাবিবর রহমান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও হন নির্বাচিত। এমপি থাকাকালীন টানা ১৫ বছরে তিনি ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন হাবিবর রহমান ও তার ছেলে আসিফ ইকবাল সনি। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাবা-ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। দুদকের বিশেষ পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর ও মীর আহমেদ আলী সালাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান। পৃথক আবেদনে বলা হয়, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, কমিশন-বাণিজ্য ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে পলায়ন করতে পারেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, হাটের ইজারা ও টেন্ডার বাণিজ্য, পদবাণিজ্য, টিআর কাবিখা থেকে কমিশন বাণিজ্য, জমি ও পুকুর, বিল দখলসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাবা-ছেলের ত্রাসের রাজত্ব ছিল শেরপুর-ধুনটে। এক সময় ব্যাংকের কাছে ঋণগ্রস্ত হাবিব তিন মেয়াদে এমপি থেকে সম্পদ বাড়িয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩০০ গুণ। ধনীর কাতারে এনেছেন ছেলে, ব্যক্তিগত সহকারীসহ আত্মীয়স্বজনদেরও। ৫ আগস্টের পর থেকে ফাঁকা পড়ে আছে হাবিবর রহমানের শেরপুরের বিলাসবহুল বাড়ি। মাছ ভরা পুকুর, গোয়াল ভরা গরু, হরিণ ও ময়ূরের খামার, ফুল ও ফলের বাগানসহ আর কত কী ছিল বাড়িটিতে। রাজপ্রাসাদের চেয়েও কম নয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধুনটের জালশুকায় আদি বাড়ির পাশে হাবিবর রহমান ৭০ বিঘা বিল-বাইশা দখল করে এর সঙ্গে দেড়শ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলেন বাবু পার্ক সিটি। ধুনট শহরে ২১ শতাংশ জায়গার ওপর কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্যিক ভবন, শেরপুরের ছোনকায় ছেলে সনির নামে ৫০ বিঘা জমির ওপর আসিফ ব্রিক ফিল্ড, দুবলাগাড়িতে প্রাসাদসম বাগানবাড়ি ও হিমাগার, ঢাকার নিকঞ্জুতে বাবা ও ছেলের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল বাড়ি, ছোট-বড় ট্রাকসহ রয়েছে বেশ কয়েকটি লাক্সারিয়াস গাড়ি। এ ছাড়া নামে-বেনামে ছড়িয়ে আছে তাদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এসব কিছু করেছেন ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে। অভিযোগ রয়েছে, এসব সম্পদের বাইরেও তার আছে দেশ-বিদেশে আরও কয়েকশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। এসব সম্পদের উৎস তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্থানীয়দের। জানা যায়, ধুনটে ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৭টি টেকনিক্যাল ও ডিগ্রি কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে, ভাই ও ভাতিজাদের সভাপতি বানিয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করে প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হাবিব। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে হাবিব ও সনির বিরুদ্ধে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিশেষ বরাদ্দের অনেক প্রকল্পের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। অথচ ইউপি সদস্যরা প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে শুধু কাগজপত্রে সই করেছেন। লোক দেখানো অল্প কিছু কাজ করে বাকি টাকা এমপির ছেলে ও লোকজন ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা জানান, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এমপির বিশেষ বরাদ্দের টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পে প্রতি অর্থবছর ৮০০ থেকে ৯০০ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ আসত। বেশিরভাগ খাদ্যশস্য কাগজে-কলমে নামসর্বস্ব ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে তুলে নিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করা হতো। বিক্রির টাকার ৬০ শতাংশ এমপির ছেলে সনি ও পিএস মিলনকে দিতে হতো। বাকি টাকা প্রকল্প সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তাদের দিতে হতো। লুটপাটের এ ঘটনাগুলোর মধ্যেই এতিমদের বরাদ্দের ৪০ টন চাল পিএস মিলন কালোবাজারে বিক্রি করে সমালোচিত হন। তবে এ ব্যাপারে মিলনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, হাবিবর ও সনির নামে আলোচনা-সমালোচনা করলেই সাজানো মামলায় ফেঁসে দেওয়া হয়। নেমে আসত অমানবিক নির্যাতন। এই কয়েক বছরে এমন মামলার আসামি হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী। এ তালিকায় ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি টিআইএম নুরুন্নবী তারিক, উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই খোকনও। এ দুজনসহ ২৮ নেতাকর্মীকে ফাঁসানো হয় চুরির মামলায়। সেই সময় খোকনের স্ত্রী ও ছেলের নামেও দেওয়া হয় ১৬ মামলা। এ ছাড়া এলাঙ্গী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহানুর রহমান অসীমসহ সাত ছাত্রলীগ নেতার নামেও রয়েছে মামলা। এলাঙ্গী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রাসেল মাহমুদসহ আরও পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে চুরির মামলা। আওয়ামী লীগ নেতা রিয়েল আহম্মেদ জান্নাত, সাবেক বন ও পরিবেশ সম্পাদক আরিফুর রহমানের ‘অপরাধ’ তারা প্রতিপক্ষ গ্রুপের সমর্থক। এ কারণে তারা দুজনসহ যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান এখন হত্যা মামলার আসামি। চিকাশী ইউনিয়নের নেতারা এমপির ছেলের অনৈতিক কাজে সায় না দেওয়ায় মামলার আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন সভাপতি আলেফ বাদশার বিরুদ্ধে ১৮, যুগ্ম সম্পাদক ইউপি সদস্য মোকলেছার রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি, সদস্য সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ছয়টি, ওয়ার্ড সভাপতি শিপন মিয়ার বিরুদ্ধে ১৮টি ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পলাশ হাসানের বিরুদ্ধে ১৮ মামলা রয়েছে। এর বাইরেও অনেক নেতাকর্মী মামলার আসামি হয়েছেন। ২০১৮ সালের ৩১ মে হাবিবর রহমান, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তদন্ত শুরু করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় থেকে তাদের জায়গা-জমি, ফ্ল্যাট কেনাবেচা-সংক্রান্ত রেকর্ডের ছায়ালিপি চেয়ে বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক প্রধান কার্যালয় অনুসন্ধান শুরু করে। প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম গত ১৯ এপ্রিল বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রারকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, হাবিবর রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন-সংক্রান্ত অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা প্রয়োজন। তাই হাবিবর রহমান, তার স্ত্রী খাদিজা হাবিব, ছেলে আসিফ ইকবাল সনি ও মেয়ে ফারহানা দিবার নামে জায়গা, জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ছায়ালিপি ২৫ এপ্রিলের মধ্যে সরবরাহে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু পরে সেই তদন্ত আর এগোয়নি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে পরিবারসহ আত্মগোপনে অভিযুক্ত হাবিবর রহমান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও নিহতের ঘটনায় তার ও তার ছেলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। ধুনটের চৌকিবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, হাবিবর রহমান জালশুকায় বাবু সিটি পার্কের প্রায় ১৮০ বিঘা জমি ক্রয় করেন ও ৮০ বিঘা সরকারি জলাশয় ১০০ বছরের জন্য অনিয়মতান্ত্রিকভাবে লিজ নিয়েছেন। এতে করে জেলেদের পেটে লাথি মারা হয়েছে। এই লিজ প্রথা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। ধুনট উপজেলা বিএনপির সভাপতি তৌহিদুল আলম মামুন বলেন, স্বৈরাচার সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা সেবার নামে লুটপাট করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। ধুনটেও একই চিত্র। গত ১৫ বছরে স্কুল-কলেজে নিয়োগে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন হাবিবর। এ ছাড়া টিআর কাবিখাসহ সরকারি প্রকল্পে তার অনিয়মের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এখন সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। শেরপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বাবলু বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে হাবিবর ঋণগ্রস্ত ছিলেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বাবা-ছেলে মিলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেন। দুদক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকের বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত।