ত্রুটিমুক্ত করার উদ্যোগ জুলাই-আগস্টের মামলা


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে ব্যাপকহারে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ নানাজনকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব মামলার অধিকাংশ এজাহারই ছিল ত্রুটিযুক্ত, যার মাধ্যমে প্রকৃত আসামিদের বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই মামলাগুলোকে ত্রুটিমুক্ত, নিখুঁত ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে অভিযুক্ত একজনকেও ছাড় দেওয়া হবে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও পুলিশ সদর দপ্তরের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও আদালতে মামলা হয়েছে ৩৯৯টি। সারা দেশে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৬৯৫টি (১৩ অক্টোবর পর্যন্ত)। ঢাকার মামলাগুলোর মধ্যে কয়েকটি মামলা আছে জুলাই-আগস্টের পূর্ববর্তী ঘটনার। অপর মামলাগুলো সবই জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন, আন্দোলনে গুলিবর্ষণ, হামলা, উসকানি দেওয়া, অর্থ দাতা, হুকুম দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগে। বেশ কিছু মামলা দায়েরের পর প্রায় তিন মাস পার হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত জোরালোভাবে তদন্ত শুরু করতে পারেনি পুলিশ। ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পুলিশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল। অধিকাংশ থানা ও ফাঁড়ি লুট এবং হামলা হয়েছে। ওই সময় ডিএমপিতে কর্মরত ঊর্ধ্বতনও কর্মকর্তাদের অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছে। অনেককে চাকরিচ্যুত বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা নানা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছে। সব মিলিয়ে পুরো পুলিশ বাহিনীতে ছিল চরম বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যার ফলে হত্যা মামলাসহ অনেক মামলা হলেও সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করা যায়নি। এমনকি মামলার আসামি যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং যাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তাদেরও সুচারুভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। এ ছাড়া আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনরা এজহার দিয়েছেন। সেগুলোও অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আদালতেও অনেকে ত্রুটিযুক্ত অভিযোগ দিয়েছেন। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে পুলিশ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। পুলিশের থানা ও ইউনিটগুলো পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। তাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংক্রান্ত এজহারে থাকা ত্রুটিগুলো দূর করে সুচারু তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।’ আসামিদের বিরুদ্ধে গণহারে হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে কেন? জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা করা হয়েছে মূলত আসামিদের আটক রাখা বা তারা যাতে সহজে জামিন না পায়, সে লক্ষ্যে। এখন মামলাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে, অভিযোগপত্রে তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণসহ আদালতে উপস্থাপন করা হবে এর মাধ্যমে প্রকৃত আসামিদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মো. মাইনুল হাসান এনডিসি বলেন, ‘আমরা চাই নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়। ত্রুটিমুক্ত তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।’ ৫ আগস্টের পর দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলার এজহার সূত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল দিয়ে গুলি বর্ষণ করতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও চাইনিজ রাইফেল দিয়েও গুলি করা হয়েছে। ফেনীতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারীরা এ কে-৪৭ ও এম-১৬- রাইফেলের মতো ভয়ানক রাইফেল দিয়েও গুলি করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গণহত্যা বা হত্যার বেশ কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল ও বিভিন্ন আদালতেও। আদালতে হওয়া মামলাগুলো এজহার হিসেবে নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৭ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোববার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অপর দিকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাবেক ১০ মন্ত্রীসহ ১৪ জনকে। আগামী ১৮ নভেম্বর তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের মামলায় যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তারা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সাবেক সমাজক্যলাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জুনাইদ আহমেদ পলক, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শাহজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পৃথক মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলি করে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রায় ২শ’ হত্যা মামলাসহ প্রায় আড়াইশ’ মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় গত ১৫ আগস্ট ঢাকার আদালতে। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সিরিজ মামলা শুরু হয় এবং তা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা-গুলিসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে ১ হাজার ৬৯৫টি (১৩ অক্টোবর পর্যন্ত) মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, তাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন, সহযোগী রাজনৈতিক দল, জোটভুক্ত দল, আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ী, শিক্ষক, আমলা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। সব মামলার ত্রুটিমুক্ত নির্ভূল তদন্তে পুলিশ কাজ করছে। নিজ নিজই ইউনিট প্রধানগন বিষয়টি মনিটরিং করছেন। মামলার ত্রুটিপূর্ণ এজহারে বিচারের অন্তঃরায় তৈরি হবে কি না, জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘এজহার বা এফআরের ওপর বিচার নির্ভর করে না। মামলার বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চার্জশিট বা পুলিশ প্রতিবেদন। সঠিক পদ্ধতিতে সফল তদন্তের মাধ্যমে সফল বিচার করা সম্ভব। আসামিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণের স্বপক্ষে পর্যাপ্ত অ্যাভিডেন্স পাওয়া গেলে দোষীদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর পর্যাপ্ত অ্যাভিডেন্স সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে অনেক দোষী ব্যক্তিও পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।