ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ের হত্যার পরেই অভিযোগের তীর উঠেছিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে। ইরান সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরাইলকে ‘কঠিন শাস্তি’ দেওয়ার হুমকিও দেয়।
ইসরাইলের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো বক্তব্য না এলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে তার দেশ সাম্প্রতিক সময়ে তার ‘শত্রু’দের চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার মতো আঘাত হেনেছে।
বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন হানিয়ের হত্যার পরেই বলছিলেন ইসরাইলই হানিয়েকে হত্যা করেছে বলে ধরেই নেওয়া যেতে পারে।
অবশ্য এই প্রথম নয়, এর আগে বহুবার এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদ কোনো পর্যায়ের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এবং গত কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আন্দাজ পাওয়া যায় যে ইরানে অতি উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদেরও তারা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট অপারেশন চালানোর জন্য।
ইসরাইলের সেই সব অপারেশনের মধ্যে যেমন রয়েছে খুন, তেমনই রয়েছে সাইবার আক্রমণ এবং ড্রোন দিয়ে হামলা।
এইসব হামলার বেশ কয়েকটির মধ্যে একটা যোগসূত্র দেখা গেছে, তা হল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি।
ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে যে তেহরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, যার ফলে ইসরাইলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে পারে। ইরান সামরিক পরমাণু কর্মসূচির কথা অস্বীকার করলেও তারা বলে যে বেসামরিক পরমাণু শক্তির উন্নয়নের অধিকার তাদের আছে।
দেখে নেওয়া যাক ইরানের মাটিতে মোসাদ কী কী ঘটনা ঘটিয়েছে গত প্রায় দেড় দশকে।
হত্যা
এমন একাধিক ইরানি বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোরের একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার গত প্রায় দেড় দশকে খুন হয়েছেন, যেগুলোর পেছনে ইসরাইল তথা মোসাদের হাত ছিল বলে দাবি করে ইরান।
• জানুয়ারি ২০১০ :
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদ-আলি-মোহাম্মদী তার মোটরসাইকেলে রাখা রিমোট পরিচালিত বোমার আঘাতে নিহত হন। বাড়ির কাছেই ওই ঘটনা ঘটেছিল।
বিবিসির ওয়েবসাইটে ১২ জানুয়ারি, ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছিল। সেখানে এও লেখা হয়েছিল যে প্রাথমিক ভাবে ইরানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল যে তিনি একজন পরমাণু বিজ্ঞানী ও সরকারের সমর্থক ছিলেন।
তবে পরবর্তী প্রতিবেদনগুলিতে লেখা হয় যে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না এবং বিরোধীদের তোলা একটি পিটিশনে তিনি সইও করেছিলেন।
ঠিক এক বছর পরে, বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল ‘১০ জানুয়ারি ইরান ঘোষণা করেছে যে অধ্যাপক মোহাম্মদীকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তারা দশজন ইরানি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।’
ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ তখন দাবি করেছিল যে ধৃতরা ইসরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন এটা তারা স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন। তবে বিবিসি এটাও লিখেছিল, সেই সব স্বীকারোক্তি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
• নভেম্বর ২০১০ :
তেহরানের শহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাজিদ শাহরিয়ারি কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একটি গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। আহত হন তার স্ত্রীও। তৎকালীন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ওই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে দায়ী করেছিলেন।
• নভেম্বর ২০২০ :
তেহরানের বাইরে গাড়ি চেপে যাওয়ার সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ। পশ্চিমা দেশগুলি এবং ইসরাইলি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করতেন যে ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক।
জাতিসংঘ ২০০৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে তার ওপরে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল।
বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইট ২০২০ সালের পয়লা ডিসেম্বর এক প্রতিবেদন লিখেছিল, ‘ইরানের ধারণা, শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে গুলি করে হত্যা করতে ইসরাইল ও নির্বাসিত বিরোধী গোষ্ঠী রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করেছে।’
ঘটনার বছর দুয়েক পরে এক বিশ্লেষণে বিবিসি পারসি সার্ভিসের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল, যেভাবে ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি তথ্য না পেলে ওইভাবে একটি চলমান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায় না!
একটা সময়ে ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তবে সরকার জোর দিয়ে বলে যে তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়, এটাও জানিয়েছিল বিবিসি।
• মে ২০২২ :
ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসি-র কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে পাঁচবার গুলি করে খুন করা হয়। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মাজিদ মিরাহমাদি ওই হত্যাকাণ্ডকে ‘নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েলের কাজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে ইরানের সরকারি গণমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছিল, ‘কর্নেল খোদাই আইআরজিসি-র বিদেশ অভিযান শাখা – কুদস ফোর্সের সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে তারা।’
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ওই হত্যাকাণ্ডের পিছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে ‘বৈশ্বিক ঔদ্ধত্য’কে দায়ী করেছেন, এমনটাও জানিয়েছিল বিবিসি।
সাইবার হামলা
• জুন ২০১০ :
ইরানের বুশেহর শহরের পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে স্টাক্সনেট ভাইরাস পাওয়া যায় এবং তা সেখান থেকে অন্যান্য প্রকল্পে ছড়িয়ে পড়ে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল: ইরানের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারগুলি একটি জটিল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা ইরনা।
তবে বুশেহর প্ল্যান্টের অপারেটিং সিস্টেমের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সেখানকার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহমুদ জাফারি।
স্টাক্সনেট ভাইরাস একটি শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভাইরাসটি এতই জটিল যে এটি কেবল কোনো ‘জাতিরাষ্ট্র’-ই বানিয়ে থাকতে পারে।
সে বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১৪ টি প্রকল্পের প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল।
• মে ২০১২ :
ইরান ঘোষণা করে যে ফ্লেম নামে একটি ভাইরাস ব্যবহার করে সরকারি কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদনে এই ফ্লেম ভাইরাসটি নিয়ে লেখা হয়েছিল। সাইবার-নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাস্পারেস্কি ল্যাবস্-কে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছিল যে ফ্লেম ভাইরাসটি “এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে জটিল” ভাইরাস।
ক্যাস্পারেস্কি এটাও বলেছিল যে তারা মনে করে এই ভাইরাস আক্রমণ কোনও রাষ্ট্রই চালিয়েছে, তবে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।
• অক্টোবর ২০২১ :
ইরানের নাগরিকরা ভর্তুকি হারে জ্বালানি কেনার জন্য যে সরকারি কার্ড ব্যবহার করেন, তার ব্যবস্থাপনাতেই সাইবার হানা হয়। দেশের ৪,৩০০টি পেট্রোল স্টেশনই এর ফলে প্রভাবিত হয়।
গ্রাহকদের হয় নিয়মিত দামে জ্বালানি কিনতে হয়েছিল – যা ভর্তুকি-যুক্ত দামের দ্বিগুণেরও বেশি, অথবা কেন্দ্রীয় বিতরণ ব্যবস্থাপনায় স্টেশনগুলি যতক্ষণ না আবারো সংযোগ করতে পারে, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
এই ঘটনার জন্য ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিল ইরান।
• মে ২০২০ :
ইরানের দক্ষিণ উপকূলে শহিদ রাজাই বন্দরে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার ব্যবস্থাপনায় সাইবার হানা হয়।
ওই সাইবার হামলার ফলে বন্দরে আসার জন্য জাহাজগুলিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ওয়াশিংটন পোস্ট এই খবরটি দিয়ে জানিয়েছিল যে ওই হামলার পেছনে ইসরাইলের হাত রয়েছে। তবে ইসরাইল ওই সাইবার হামলার দায় স্বীকার করে নি।
ড্রোন হামলা ও গুপ্ত অভিযান
• জানুয়ারি ২০১৮ :
মোসাদ এজেন্টরা তেহরানের একটি সুরক্ষিত স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে বলে ইরান অভিযোগ করে।
আল জাজিরার একটি খবরে বলা হয়, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঘোষণা করেন যে ইসরাইল এমন এক লক্ষ ‘গোপন ফাইল’ হাতে পেয়েছে, যা দিয়ে প্রমাণ হয় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালায় না বলে যেটা বলে থাকে, তা অসত্য।
• ফেব্রুয়ারি ২০২২ :
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয়তে স্বীকার করেছিলেন যে তার আগের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরাইল একটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশানারি গার্ড কোরের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করেছে।
• মে ২০২২ :
বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন আঘাত হানে তেহরানের দক্ষিণ-পূর্বে পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে। ওই ঘটনায় একজন প্রকৌশলী নিহত হন।
ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী যে ভবনে তাদের নিজেদের ড্রোন তৈরি করত, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছিল।
• এপ্রিল ২০২৪ :
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাস ভবনে ইসরাইলি হামলায় সাতজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন বলে বিবিসি জানিয়েছিল।
নিহতদের মধ্যে কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদী ও তার ডেপুটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রাহিমিও ছিলেন।
এর জবাবে ইরান শয়ে শয়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরাইলে।
দুই শত্রু দেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে চলা ছায়া যুদ্ধের পর এই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরাইলে হামলা চালাল, এমনটাই লেখা হয়েছে বিবিসির ওয়েবসাইটে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।