সম্পদের নেশায় বুঁদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া


কুমিল্লা-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া যেন ‘ল্যান্ডলর্ড’। নিজ ও পরিবারের নামে ঢাকা, গাজীপুর ও কুমিল্লায় রয়েছে প্রায় আড়াইশ বিঘা জায়গা-জমি। রাজধানীর কাঁঠালবাগানে আছে ১০তলা টাওয়ার। মহাখালী ডিওএইচএসে আছ ৫তলা বাড়ি। কুমিল্লায় গড়ে তুলেছেন একাধিক বহুতল ভবন ও বিশাল চিড়িয়াখানা। তার বিরুদ্ধে আছে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ। সব মিলিয়ে ভূঁইয়া পরিবারের সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। টানা চারবার সংসদ-সদস্য থাকাকালে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিমে আছেন সংস্থার উপপরিচালক রেজাউল করিম, ফেরদৌস রহমান ও সহকারী পরিচালক শহিদুর রহমান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে সুবিদ আলী ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও সুবিদ আলী পরিবারের সদস্যদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাদের বক্তব্য।জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা সুবিদ আলী ভূঁইয়া ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা চারবার কুমিল্লা-১ আসনের সংসদ-সদস্য ছিলেন। প্রায় পুরো সময়টাই তিনি সম্পদ করার নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন। এ সময় তিনি নিজে, স্ত্রী মাহমুদা আক্তার ও বড় ছেলে দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন উন্নয়নকাজের ঠিকাদারির কমিশন, বালুমহাল ও টোল প্লাজা থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অবৈধ উৎস থেকে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ এসব সম্পদ কেনায় বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া আলোচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতিতেও জড়িত সুবিদ আলী পরিবার।দুদকের তথ্যমতে, গাজীপুর মাজুখান বাজারের দক্ষিণে রেললাইনের পাশে সুবিদ আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১৫ বিঘা জমি রয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতায় চামড্ডা মৌজায় এশিয়ান হাইওয়ের পাশে ১৫ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুরে আছে অন্তত ৩০ বিঘা জমি। গাজীপুরের এসব জায়গার দাম শতকোটি টাকার বেশি। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার গণকবাড়ি/গোবিন্দপুর মৌজায় আছে ১৫ বিঘা জমি। যার দাম অন্তত ৩০ কোটি টাকা। মিরপুর ডিওএইচএস ৩০০ ফুট এক্সপ্রেসসংলগ্ন এলাকায় আছে আরও ৫ বিঘা জমি। ঢাকার জলসিঁড়ি প্রকল্পে ছেলে মোহাম্মদ আলীর নামে আছে ৫ কাঠার প্লট। বরুয়া মৌজার ৫ বিঘা জমি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন আশিয়ান সিটির কাছে। ঢাকার কলাবাগানে ৭ কাঠা জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন ‘ডিকে টাওয়ার’। নিজস্ব তহবিল থেকে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনের বেজমেন্ট ও প্রথম তলা করার পর ব্যাংক ঋণ নেন। এ ভবনের দামই প্রায় শতকোটি টাকা। মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় ৫ কাঠা জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ৫ তলা বাড়ি। যার দাম প্রায় ৩০ কোটি টাকা। দুদক আরও জানতে পেরেছে, ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় নিজস্ব নির্বাচনি এলাকায় বিপুল সম্পদ রয়েছে সুবিদ-পরিবারের। দাউদকান্দির জুরানপুর, বরারচর ও ঝাউতলি মৌজায় রয়েছে প্রায় ১৫০ বিঘা জমি। যার দাম শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দাউদকান্দি পৌর সদরে ওজারডাঙ্গা মৌজায় ৪০ শতাংশ জায়গায় বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। দাউদকান্দি জুরানপুরে মাহমুদা হাউজের (ছাত্রী হোস্টেল) মালিক সুবিদ আলীর স্ত্রী মাহমুদা আক্তার। এ ছাত্রী হোস্টেলে জুরাননগর ডিগ্রি কলেজের মালিকানা না থাকলেও জেলা পরিষদের বিভিন্ন খাতের বিশেষ বরাদ্দ নির্মাণকাজে খরচ করা হয়েছে। জুরাননগরে দুই ছেলের নামে ‘শতকত আলী হাউজ’ ও ‘জুলফিকার আলী হাউজ’ নামে আরও দুটি বহুতল ভবন রয়েছে। এ ভবন দুটিও ছাত্রী হোস্টেল হিসাবে ভাড়া দেওয়া। ছেলেদের নামে ভবন করা হলেও মালিকানা সুবিদ আলী ও স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের নামে। এই ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণেও সরকারি বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জুরাননগর ডিগ্রি কলেজের সামনে বিশাল মাঠ সুবিদ আলী পরিবারের ব্যক্তিমালিকানার জায়গা। ২০০৯ সালের আগে এ জায়গা ৭ ফুট গভীর ছিল। এ মাঠও ভরাট করা হয়েছে সরকারি অর্থে। জুরাননগর বাজারের উত্তর পাশে অন্তত ২০ বিঘার খেলার মাঠটির মালিক সুবিদ আলী পরিবার। এটি একসময় ১০/১২ ফুট গভীর জলাশয় ছিল। ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার বিশেষ বরাদ্দ ও টিআর-কাবিখা প্রকল্পের অর্থে এ জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে জায়গার একপাশে খেলার মাঠ করে উপজেলা প্রশাসনের অর্থায়নে বসার জায়গা তৈরি করা হয়। জুরানপুর ডিগ্রি কলেজের পশ্চিম পাশের কিন্ডারগার্টেন ও বিশাল মাঠটিও সুবিদ আলী পরিবারের মালিকানায় হলেও উন্নয়নকাজ করা হয়েছে সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে। জুরাননগর চিড়িয়াখানাটিও তার নিজস্ব মালিকানায়। কিন্তু এ চিড়িয়াখানার উন্নয়নে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সরকারি অর্থে ব্যক্তিমালিকানায় জায়গা-জমি উন্নয়নের এসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে দুদক।এছাড়া ঢাকার সোনালী, জনতা, ইসলামীসহ বিভিন্ন ব্যাংকে অন্তত ১০ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত ও সঞ্চয়পত্র রয়েছে সুবিদ পরিবারের সদস্যদের নামে। উল্লিখিত তথ্য যাচাই-বাছাই ও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ভূমি অফিসে চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুদক।জানা যায়, সুবিদ আলীর মেজো ছেলে শওকত আলী যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। সেখানে তার কোনো ব্যবসা বা চাকরি নেই। অভিযোগ আছে, বাবার পাচার করা বিপুল অর্থে সেখানে বাড়ি-গাড়ি কিনে বিলাসী জীবনযাপন করেন ছেলে। ছোট ছেলে জুলফিকার আলী থাকেন মার্কিন মুল্লুকে। সেখানেও বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছে। কেনা হয়েছে বাড়ি-গাড়ি। আরও জানা যায়, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিতে বিতর্কিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের উপদেষ্টা ও পরিচালক ছিলেন সুবিদ আলীর বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ছিল সুবিদ আলীর মালিকানাধীন ডিকে টাওয়ারে। তার প্রভাবেই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি। এই ঋণের কমিশন মোহাম্মদ আলীও পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতিতে মোহাম্মদ আলীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনুসন্ধান শেষে মামলা করেছিল দুদক। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাবে তখন মামলার চার্জশিট থেকে মোহাম্মদ আলীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল।অর্থের উৎস : বাবা সাবেক সংসদ-সদস্য ও ছেলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের প্রভাববলয়ে দাউদকান্দি এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডার ও মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয়েছিল নিজস্ব বাহিনী। দাউদকান্দি এলাকার এসব অবৈধ খাতের একক নিয়ন্ত্রক হিসাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সুবিদ আলী পরিবার। অভিযোগ আছে, দাউদকান্দি পৌর সদরের চালবাজারে ২০০টি ভিটি বরাদ্দে ডিও লেটার দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। গৌরীপুর বাজারে ২০০টি ভিটি তিতাস উপজেলার জিয়ার কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশ্রাফকে বরাদ্দ দিতে জেলা প্রশাসনকে ডিও লেটার দিয়ে আদায় করা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের শৈবাল, সুগন্ধা, এশিয়া, পানকৌড়ি, রুপালি, আরডিবিসহ ৫০টি প্লাবন ভূমিতে মৎস্য প্রকল্পের অনুমোদনের নামে নেওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। উপজেলার পরিবহণ খাত থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করেছেন মোহাম্মদ আলীর বাহিনী। দাউদকান্দি টোল প্লাজার বালুমহাল ঘাট থেকে ১৫ বছরে চাঁদা আদায় করা হয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। ১৫ বছরে ওরিয়ন গ্রুপের তত্ত্বাবধানে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজার দাউদকান্দি অংশ থেকে চাঁদা আদায় করা হয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া দাউদকান্দির সব উন্নয়ন কাজের কমিশন বাণিজ্যের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অবৈধ পথে উপার্জিত এ অর্থ জায়গা-জমি কেনায় বিনিয়োগ ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।