আস্থা-অনাস্থায় আনন্দাতঙ্ক!


আশির দশকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বহুল পরিচিত সেই শব্দগুলো বা ‘সাউন্ড অ্যাফেক্ট’ আবারও শুরু হয়ে গেল তো গেলই! তখনকার দিনে হরতালের আগের রাতে ভয়ংকর শব্দে ককটেল, বোমা ফুটলে জনগণ বুঝতে পারত আগামীকাল খবর আছে। সবাই পরদিনের জন্য সেভাবেই প্রস্তুতি নিতেন। বড় সাহেবরা অতি ভোরে অফিসে যেতেন, লাগাতার হরতাল হলে কেউ কেউ অফিসেই রাত কাটাতেন। সে সময় এক হরতালের দিন দেরি করে হেঁটে অফিসে যাওয়ার সময় এক বড় সাহেবের প্যান্ট খুলে দিগম্বর করার ঘটনা জাতি আজও লজ্জার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। সেই হরতাল, অবরোধ, ভয়তাল, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, লাগাতার ইত্যাদি শব্দগুলো বেশ ক’বছর ধরে জাতি ভুলেই বসেছিল; কিন্তু গেল ২৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে রাজপথে আবারও হাজির হয়েছে বিকট শব্দ, কাঁদানে গ্যাস, গুলি, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি। সেদিনের হাজারও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনার পর আরও বিকট শব্দ শোনার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ব্যাপক হারে গণগ্রেফতার ও কারাগারে সঁপে দেওয়ার মাধ্যমে শব্দদূষণের সমাপ্তির আশাকে উবে দিয়ে পোড়াপুড়ির কালো ধোঁয়ার আগমনের মাধ্যমে বায়ুদূষণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছে। সঙ্গী করে এনেছে শীতের কুয়াশা, ধুলোবালির সমন্বয়ে ‘স্মগের’ চাদর। ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা সবকিছুর মধ্যে আস্থা-অনাস্থায় এক ধরনের আনন্দাতঙ্ক তৈরি করে পরিবেশ ভারী করে দিয়েছে। একসঙ্গে এতকিছুর সমাহার নতুন করে সবার মনে দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। এই দুশ্চিন্তার কারণ অন্য জায়গায়। ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বেশ ঘটা করে জাতীয় নির্বাচন ২০২৪-এর তফশিল ঘোষিত হয়। এ নির্বাচনি তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এত নিরাপত্তা প্রস্তুতি শুধু জাতিকে নয়-সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আমাদের নির্বাচন নিয়ে আরও বেশি কৌতূহলের উদ্রেক সৃষ্টি করে ফেলেছে। একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে যে সময় বড় বিরোধী দলগুলোর নেতারা কারাগারে, ক্ষমতাসীনদের ভাষায় বিরোধী কর্মীরা সবাই গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ‘ইয়া নফসি’ করছে, তখন সেই গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা করতে গিয়ে এত নিরাপত্তা বলয় দেখে মানুষ কিছুটা বিস্মিত। তফশিল ঘোষণার জন্য এ ‘ভয়তালি’ কেন তৈরি করতে হলো? এটা কি শুধুই সতর্কতা নাকি কোনো গৃহযুদ্ধ অথবা যুদ্ধের প্রস্তুতি? সেদিনের রাস্তার চেহারা যারা দেখেছে তাতে যে কারও ভিরমি খাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কোনোভাবেই এটাকে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতির চিত্র বলে আমার মনে হয়নি। এমনকি পরবর্তীতেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অজানা আশঙ্কা মানুষকে নানা ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। একদিকে থমথমে অবস্থা, অন্যদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি। নির্বাচন কমিশন অফিস তো কোনো ক্যান্টনমেন্ট নয়। সেখানে নাগরিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়িও নজিরবিহীন। সেখানে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মীরা আগে কখনো কোনো নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার সময় এত নিরাপত্তা দেননি। মহারথী সাক্ষাৎপ্রার্থীরাও জানিয়েছেন, ইসিতে প্রবেশ করতে গিয়ে এমন বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন তারা আগে হননি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার আগে যদি এমন ভীতিকর অবস্থায় থাকতে হয়, তাহলে নির্বাচনের দিন কী করা হতে পারে? এমন আলোচনা আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে আরও বেশি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একটি দেশের নির্বাচন কমিশন সব সময় স্বাধীন নীতিতে কাজ করে থাকে। তফশিল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজ ছাড়াও দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর প্রতিও তাদের দায়িত্বের সঙ্গে নজর রাখতে হয়। এটা করতে গিয়ে দেশের সব জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হয়। অন্যের আদেশে আদিষ্ট হয়ে দলকানা নীতি প্রতিপালন করতে গেলে সেখানেই ঘটতে পারে বিপদ। সেই ধরনের বিপদের ঘনঘটা তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে। তাই তো তফশিলের ঘোষণার আগেই মিষ্টি কেনার টাকা সংগ্রহ করা নিয়ে নেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে কাউকে কাউকে দেখা গেছে। জনতার একটি নির্দিষ্ট অংশের আনন্দ মিছিল করার ইতিহাস কি কোনো দেশে এর আগে ঘটেছিল? ভোটের তারিখ শুনে যদি এ ধরনের আনন্দ মিছিল করতেই হয় তবে তা দেশের সব নাগরিকের একসঙ্গে করার কথা। কেউ আনন্দ মিছিল করবে আবার কেউ ঢিল ছুড়বে, গাড়ি পোড়াবে এমন পরিস্থিতি কী জানান দেয়? তফশিল হতেই রাজপথ দখল করে নির্বাচনি পক্ষ-বিপক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে আচরণ ও চিৎকার-ধ্বনি দেওয়ার ভিন্নতা একটি অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সেদিন রাস্তায় ব্যাপক জনসমাগম দেখে গোটা দেশের পথঘাট যানবাহনশূন্য হয়ে হরতালাবস্থা তৈরি করে! অফিস ফেরতরা সেদিন গণপরিবহণ পাননি। সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ অজানা ভয়ে ঘরের ভেতরে অবস্থান নিয়ে কিছু চেনা টিভিতে একপেশে বক্তব্য শুনে হতাশ হয়েছেন। বিরোধীপক্ষ গর্তের মধ্যে কাঁথার নিচে শুয়ে ভেবেছেন, তফশিল ঘোষণা হতেই ওদের আনন্দ মিছিল, হর্ষধ্বনি, মিষ্টি বিতরণ, তাহলে আবার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করা কেন? ভোটের তারিখ শুনেই যদি আনন্দ মিছিল করতে হয়, তবে অযথা ভোটের আয়োজন কেন? এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভোটের আয়োজন করতে হবে কেন? ভিয়েতনামের নেতা হুনসেন অথবা চীনের নেতা শিন জিনপিংয়ের মতো পার্লামেন্টে একটি ছোট্ট অধিবেশন ডেকে সারা জীবন প্রধান থাকবেন-এমন আইন পাশ করলেই তো হলো! কথায় বলে, ‘ভোগের কিল মায়ে কিলায়, না হয় মাচা ভেঙে মাথায় পড়ে।’ যারা তফশিল ঘোষণার পর থেকেই মিষ্টি বিতরণ, আনন্দ মিছিল, হর্ষধ্বনি দেওয়ার জন্য লোকদের রাস্তায় জড়ো করেছে, তাদের অনেক টাকা। ওরা নমিনেশন পাওয়ার জন্য দৌড় শুরু করার পর খেলা জমবে বেশ। এবার খেলা হবে ওদের সঙ্গে ওদেরই। অর্থাৎ, নিজের সঙ্গে নিজেদের দলের মানুষের। নমিনেশন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহ ও কোন্দল তৈরি হওয়ার আশঙ্কা অবান্তর কিছু নয়। গত নির্বাচনের পর থেকে বিশেষ একটি দলের নমিনেশন পওয়াটাই ‘সাত রাজার ধন’ হাতে পাওয়া মনে করার ফলে অনেকেই যে কোনো কিছুর বিনিময়ে একটা নির্বাচনি যুদ্ধের টেনশনমুক্ত অতিসহজ নির্বাচন করতে আগ্রহী। তবে এ দৌড়ে কার মাচা ভেঙে মাজা ভাঙবে আর কার মাথায় মৌচাক ভেঙে মধু গড়াবে তা বলা কঠিন। নমিনেশনবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র দাঁড়াতে গিয়ে কলহ বাঁধাবে। হয়তো আরও দল, উপদল তৈরি করবে। মারামারি, কাটাকাটি করবে। তখন খেলাটা আরও জমে উঠবে বলে মনে হয়। এসব কারণে ঘরের ইঁদুর বেড়া কাটতে থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। তখন রাস্তায় থাকা নিরাপত্তা বাহিনী কী করবে, কে কার পক্ষ নেবে বলে মনে হয়? তখন নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিয়ে কারা মিছিল করবে? আর অনাস্থার কারণ কারা হরতাল ডাকবে, মারামারি, কাটাকাটি করবে? এছাড়া নির্বাচনি অদৃশ্য ভূতপ্রেত ঠেকাবে কোন ওঝা? তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে তখন যদি ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে যাবে কে বা কারা? এসব ভেবে কূল-কিনারা করতে না পেরে চিন্তাদূষণ হচ্ছে সাধারণ নিরীহ ভোটারদের। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা সবকিছুর মধ্যে আস্থা-অনাস্থায় এক ধরনের আনন্দাতঙ্কের আবহ তৈরি করে পরিবেশ ঘোলাটে করে ফেলেছে। যা ইতোমধ্যে অজানা বৈরী বাতাস সৃষ্টির জন্য গুমোট ভাব ধারণ করে আছে। আরও সময় না গড়ালে এর হিসাব মেলানো খুব কঠিন। ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন fakrul@ru.ac.bd