ইতিহাস ভুলে যাওয়া সেই ‘জেনোসাইড’
আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; খণ্ডকালীন শিক্ষক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালি তথা বাংলাদেশের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস। এক অর্থে আবার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমনটি বলছেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক, \'প্রাণের বিনিময়ে, রক্তগঙ্গা পেরিয়ে মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায় হয়েছিল পরাধীন দেশে।\' নানা ব্যঞ্জনায় আমাদের সামনে আজ উপস্থিত এই ফেব্রুয়ারি মাস- বাঙালির জাতিসত্তা, স্বকীয়তা আর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার রক্তাক্ত আন্দোলনের গৌরবগাথা রচিত মাস; আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনার মাস; আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস ইত্যাদি। শহীদ রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারের রক্তে ভেজা রাজপথ ধরে আন্দোলনের ফসল আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। সুতরাং \'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।\'দুই
এই মাসেরই প্রথম দিনের প্রথম প্রহরে আমন্ত্রিত ছিলাম এক অনন্য অনুষ্ঠানে। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি আয়োজন করল এক সেমিনারের, যার শিরোনাম ছিল \'রেইজিং আ ভয়েস ফর ডিক্লারেশন অব সেভেন্টি ওয়ান কিলিংস অ্যাজ জেনোসাইড\'। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওটা বিরল এক বিবেক জাগ্রতকরণ সেমিনার। বিরল ভাবলাম এই কারণে যে, আজকাল জেনোসাইড বা গণহত্যা নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা যায় না, যদিও প্রতিবেশী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর মিলিটারি জান্তার জেনোসাইড আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল এবং ঘটছে। দ্বিতীয়ত, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা বিবেক জাগরণী সেমিনারের আয়োজক, তা বুঝে উঠতে সময় নিয়েছিল বৈকি।যা হোক, নবনির্মিত মনজুর এলাহী অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম অনুষ্ঠান এই সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক। বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য এমএম সহিদুল হাসানের স্বাগত ভাষণের পর সমাপ্তিসূচক বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বর্তমানে উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।তিন
দুই ঘণ্টার ওপরে নিবিষ্ট নিবেদন। অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের \'স্টপ জেনোসাইড\' ছবি দিয়ে। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে দর্শক-শ্রোতা ফিরে গেলেন ১৯৭১ সালের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে- অস্ত্রের ঝনঝনানি, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মিছিল, বৃদ্ধ ও শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত গোছ কাছায় অস্ত্র হাতে বাঙালির প্রশিক্ষণ- \'তোমার ভয় নেই মা, আমরা অস্ত্র হাতে লড়তে জানি।\' মফিদুল হক \'জেনোসাইড\' শব্দটির সূচনা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত জেনোসাইডের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ও পরিণাম নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন- হিটলারের ইহুদি নিধন থেকে কম্বোডিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা থেকে বাংলাদেশ এবং অতি সম্প্রতি মিয়ানমার। বললেন আরও যে, জেনোসাইডের বাংলা প্রতিশব্দ \'গণহত্যা\' ব্যবহূত হয়ে এলেও এর একটি জুতসই পরিভাষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সাংবাদিক, কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড সম্পর্কে যেসব প্রামাণিক তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন, তিনি তাঁর একটি চিত্তাকর্ষক সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে। জেনোসাইড ছিল এবং দুর্ভাগ্যবশত এখনও আছে; হয়তো থাকবেও। তবে এই সেমিনারের সুবক্তার মূল সূর- জেনোসাইডকে \'না\' বলি এবং বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত হত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আওয়াজ উঠুক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন বঙ্গবন্ধুই করে গিয়েছিলেন। তাদের একটা অংশের বিচার হয়েছে এই আমলে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে গেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু গণহত্যায় লিপ্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার পেয়ে গেছে আন্তর্জাতিক আইন আর কূটনীতির ফাঁকফোকরে। সব মিলিয়ে একাত্তরে সংঘটিত জেনোসাইডের যেমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি, তেমনি থেমে থাকেনি এই জঘন্য গণহত্যা ঘটানোর অভিপ্রায়।খুব তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া ইমতিয়াজ আহমেদ জানালেন, পৃথিবীতে বর্তমানে পিপলস রিপাবলিক আছে মাত্র পাঁচটি- চীন, উত্তর কোরিয়া, আলজেরিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশ। জনগণের যুদ্ধে প্রাপ্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু পিপলস রিপাবলিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন। জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা, প্রবন্ধ প্রকাশ এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের আবর্তনে কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেক করার বাকি। তিনি আরও অবহিত করলেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার কথা। একাত্তরের জেনোসাইডের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রী। এটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ছাত্ররা প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। যার ওপর একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতে শহীদ মিনারে জাতীয় শ্রদ্ধাঞ্জলি-ভার ন্যস্ত থাকে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির আন্তর্জাতিক অনীহা কি ওই গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিল বলে?চার
তরুণ প্রজন্মের প্রসঙ্গ এসেছে বক্তাদের বক্তব্যে। মফিদুল হক বললেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মাত্র ১৯ বছর বয়সে \'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি\' গানটি লিখেছিলেন। আর এই গানটির সুর করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ, যখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছিলেন বাঙালি তরুণরা; স্বাধীনতা যুদ্ধেও তরুণরা। সুতরাং গণহত্যা বিষয়ে জানা এবং এর বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। ইমতিয়াজ আহমেদ তরুণদের উদ্দেশে বলেন, অতীত থাকে রেফারেন্সের জন্য; বর্তমান বলে কিছু নেই; থাকে একমাত্র ভবিষ্যৎ- যার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে তরুণ সমাজ।পাঁচ.
অনুষ্ঠানের সভাপতি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এই সেমিনার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানালেন, মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, জেনোসাইড হিসেবে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পক্ষে দাবি জানানো, বিশেষত তরুণ সমাজের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়াই অভীষ্ট লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে দেওয়া তাঁর সেই সময়ের ভাষণেও বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিচার দাবি করেছিলেন। তরুণ প্রজন্ম যেন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে পারে সে জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেমনটি আছে এখানে- ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ নামে একটি কোর্স থাকা উচিত। বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নয়নে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কোনো বিকল্প নেই- এ কথা সর্বপ্রথম অন্তরে অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যে কতটা সত্য ছিলেন, তার প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, প্রত্যাশিত আয়ু, প্রবৃদ্ধির হার, সামাজিক নির্দেশক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন ১ টাকার বিনিময়ে পাকিস্তানি প্রায় ৩ রুপি পাওয়া যায়।
অথচ স্বাধীনতার আগে মিলত কয়েক পয়সা মাত্র।
আসুন, একাত্তরের হত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে গণ্য করে, এর কুশীলবদের
যথাযথ শাস্তির বিধান করে জেনোসাইডকে \'না\' বলি।
