উপাচার্যের কক্ষে তালা মালিকপক্ষের


উপাচার্যের কক্ষে তালা মালিকপক্ষের
সিলেটের বেসরকারি লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. কাজী আজিজুল মাওলাকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর কক্ষ তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল সোমবার তিনি অফিসের সামনেই অবস্থান নেন।এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শিল্পপতি রাগীব আলীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন উপাচার্য। অনিয়মের অভিযোগ তুলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সম্প্রতি উপাচার্যকে জোর করে ছুটি দেন। তবে তা বেআইনি দাবি করে চেয়ারম্যান ও ‘ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য’কে উকিল নোটিশ দিয়েছেন উপাচার্য।চ্যান্সেলর (রাষ্ট্রপতি) নিযুক্ত বৈধ এই উপাচার্য এর আগে উপায়ান্তর না পেয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থাটি বলেছে, এটা মালিকপক্ষের অরাজকতা। এ এখতিয়ার তাদের নেই।উপাচার্য আজিজুল মাওলা দেশের একজন নামকরা স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক। ২০২১ সালে তিনি বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। আইন অনুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ রয়েছে।ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০০১ সালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রাগীব নগরে স্থাপিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার ৬২৩। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি বিভাগে ১৭টি কোর্স/প্রোগ্রাম চালু আছে। স্থায়ী ও খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ১১৭ জন।অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শিল্পপতি রাগীব আলী গত ১৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যকে ‘ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আপনার কর্মক্ষমতা এবং আমার সামগ্রিক মূল্যায়ন’ শিরোনামের এক পত্র দেন। এতে তিনি বলেন, গত দুই বছরে লিডিং ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অনুপস্থিতি মোট কর্মদিবসের ৫০ শতাংশের বেশিতে পৌঁছেছে।তাঁর অভিযোগ, উপাচার্য বিনা ছুটিতে বিদেশে ছিলেন। লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের স্বার্থের প্রতি তাঁর অবহেলার কারণে শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। উপাচার্য ইউনিভার্সিটির জন্য জরুরি প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি বাস কিনতেও বাধা সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। এটা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। গত দুই বছরে লিডিং ইউনিভার্সিটির কয়েক কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁকে উপাচার্য পদ থেকে আগামী ৬ মাস থেকে এক বছরের জন্য অবৈতনিক ছুটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন রাগীব আলী। পরে ট্রেজারার বনমালী ভৌমিককে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।চিঠির জবাবে উপাচার্য গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাগীব আলীকে লিখেছেন, উপাচার্যের প্রধান দায়িত্ব হলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বজায় রাখা এবং সমন্বয় সাধন করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উন্নয়নে কাজ করা। তিনি সেটাই করেছেন। বেশিরভাগ কর্মদিবস এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও ক্যাম্পাসে থেকেছেন। তাই ৫০ শতাংশ কর্মদিবসে অনুপস্থিতির অভিযোগ তথ্যভিত্তিক নয়। তাঁর সর্বশেষ ছুটি অনুমোদিত ছিল। বাস কিনতে বাধা দেওয়ার অভিযোগও উড়িয়ে দেন তিনি।আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ নাচক করে উপাচার্য বলেন, ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টগুলো ট্রাস্টি বোর্ড মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং কোষাধ্যক্ষ পরিচালনা করেন। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাংকে কোনো চেক/মানি ট্রান্সফার নির্দেশের স্বাক্ষরকারী নন। এসব প্রক্রিয়ায় কোনো অসংগতি থেকে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং কোষাধ্যক্ষ সমানভাবে দায়ী হবেন, উপাচার্য নন।এ ছাড়া, গত দুই বছরে মহামারি, বন্যা এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সমস্যা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ভর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। চিঠিতে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানকে লিখেছেন, ‘আপনার পরামর্শ অনুসারে আমার অবৈতনিক ছুটিতে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।’উপাচার্য গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইউজিসিকে এক চিঠিতে পুরো বিষয়টি জানিয়ে পরামর্শ চান। চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুমোদিত সফরে গিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর কাজে যোগদান করতে গেলে তিনি ছুটিতে পাঠানোর চিঠি পান।উপাচার্য বলেন, ‘আমাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আমাকে ছুটি দিয়ে কাউকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দিতে পারেন না। আমি আইনিভাবে সব মোকাবিলা করব।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে ‘ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য’ বনমালী ভৌমিকের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।এ বিষয়ে চেষ্টা করেও ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান রাগীব আলীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্যকে বের করে দেওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে ইউজিসিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, এটা তো অরাজকতা। উপাচার্য ইউজিসির অনুমোদন নিয়ে ছুটিতে গেছেন। ফিরে আসার পর তাঁকে যোগদানে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই এখতিয়ার কারও নেই। এ বিষয়ে ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হবে।যে কারণে বিরোধ : সিলেট ব্যুরো জানায়, উপাচার্য আজিজুল মাওলা দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিভিন্ন সময় নিয়ম না মেনে টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন উপাচার্য। ফলে এসব অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রাগীব আলীকে অনুরোধ করেন উপাচার্য। এ নিয়ে ট্রেজারার বনমালীর সঙ্গে উপাচার্যের দূরত্ব তৈরি হয়।উপাচার্য জানান, ট্রেজারার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ভুল বুঝিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ক্যাম্পাসে যেতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়।গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি ইউজিসির পরিচালককে জানান উপাচার্য।গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে যান উপাচার্য। তখন তাঁর কক্ষ তালবদ্ধ দেখেন। রাগীব আলীর পুত্রবধূ সাদিকা জান্নাতের নির্দেশে আইন বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম তালা লাগিয়ে দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই সময় কিছু বহিরাগত শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে ছিলেন।