এর নাম চিকিৎসাসেবা!


বাজার সিন্ডিকেটের দাপটে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, তার ওপর জীবনধারণের প্রধান মৌলিক যে উপাদান এবং অধিকারগুলো রয়েছে, বিশেষ করে খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা, সেগুলো থেকেও আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি বলা যায়। দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অর্থাৎ চিকিৎসাসেবার দৈন্যদশা, দুর্নীতি ও মানবতাবিবর্জিত কার্যকলাপের কারণে আমরা সাধারণ মানুষ দিশেহারা। কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া এ কষ্ট সবার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমগুলোর বদৌলতে জনগণের ভোগান্তির কিছু কিছু বিষয় প্রকাশ হলেও বা এসব নিয়ে বিজ্ঞজনরা লেখালেখি করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এগুলো পড়েন বা এসবের বিরুদ্ধে তেমন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন বলে মনে হয় না। দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব খবর বা লেখা শুধু কালির আঁচড়ে পত্রিকার পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন আর সেবাধর্মী কাজ না হয়ে এটি এখন হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। অথচ আমাদের সংবিধানে ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৩.৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছেন এবং ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন ২৪.৪ শতাংশ পরিবার। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’-এর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে রোগীদের নিজ পকেট থেকে ব্যয় হয় মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ। যদিও এ হিসাব ২০১৫ সালের। বর্তমানে এ ব্যয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমানে এই যে অব্যবস্থা চলছে, তার কারণ হিসাবে গত ১৪ আগস্ট প্রকাশিত ‘কয়েক হাজার চিকিৎসক হয়েছেন ১৬ বছরে’ শিরোনামে ডাক্তারদের নিয়ে ভয়াবহ এক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিগত ২০০১ থেকে ২০১৭-এই ১৬ বছরে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে চার হাজার ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তির ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ক্রয় করে বেশিরভাগই ইতোমধ্যে পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক হয়েছেন। জানা যায়, কোচিং সেন্টারের আড়ালে চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এভাবে বছরের পর বছর ফাঁস হয়েছে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র। সিআইডি’র সাইবার পুলিশ ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের তদন্ত করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের সন্ধান পান। ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে চার দফা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানা যায়। ২০২০ সালে মিরপুর থানায় এ বিষয়ে একটি মামলা হয়। মামলার তদন্তে জানা যায়, চক্রের প্রায় ৮০ জন সক্রিয় সদস্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। ১৩ আগস্ট সিআইডি’র সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাপ্রধান পুলিশের অতিরিক্ত আইজি এসব তথ্য দেন বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। অনৈতিক উপায়ে পাশ করা মনুষ্যত্বহীন বর্বর এসব ডাক্তার মানুষের কী সেবা দেবে? অর্থের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় পাশ করা এসব ডাক্তার সেবার নামে মানুষের গলা কাটছে। ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছে, আইসিইউতে মৃত মানুষের লাশ আটকিয়ে টাকা আদায় করছে। মনুষ্য সেবার নামে এরা রমরমা বাণিজ্য খুলে বসেছে। জানা গেছে, অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের এ সদস্যরা হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয়সহ প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এসব কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এতে দেশ থেকে মিলিয়ন, মিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য আট লাখ মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। এর কারণ দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া। এর মধ্যে রয়েছে রোগ নির্ণয়ে ত্রুটি, সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না পাওয়া, ভুল চিকিৎসায় মানুষ মেরে ফেলা, চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও সদ্ব্যবহারের ঘাটতি ইত্যাদি বহুবিধ কারণ। এক দশক আগেও সমাজের বিত্তশালীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতেন। বর্তমানে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিুমধ্যবিত্তরাও জমিজমা-ঘটিবাটি বিক্রি করে হলেও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অসংখ্য হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার কারণ মূলত সরকারি হাসপাতালে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সুষ্ঠু তদারকির অভাব ও সর্বোপরি রোগীর চাহিদা। বেসরকারি খাতের এ অগ্রগতিতে মানুষের সেবাপ্রাপ্তি সহজ হলেও অনেক ক্ষেত্রে মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কোনো নীতিমালা ছাড়াই চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। কিছু কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অবৈধ উপায়ে পাশ করা এসব ডাক্তার ভুল রিপোর্ট দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে হয়রানির সম্মুখীন করছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতও এ থেকে পিছিয়ে নেই। এ খাতে উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। আমাদের অর্জন কম নয়; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একশ্রেণির বিবেকবর্জিত ডাক্তার, বিশেষ করে লেখাপড়া না করে শর্টকার্ট পদ্ধতিতে এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পড়ে পাশ করা এসব ডাক্তারের সঙ্গে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে এরা আন্দোলন করে সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে রোগীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ১১ বছরের একটি ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। সন্তানের পাগলপ্রায় মা-বাবা গণমাধ্যমে কথা বলার সময় ডাক্তারের উপস্থিতিতে তাকে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করে তার ডাক্তারি বিদ্যা এবং কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক্তারি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা তদন্ত করার জন্য মিডিয়াকে অনুরোধ করেন। এছাড়াও গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকার শিরোনাম ছিল-‘হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা, একমাত্র সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় মা’। আট বছরের কন্যাসন্তানকে জ্বরের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হাইপাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ছোট্ট শিশুটির শরীরে পুশ করে শিশুটির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে; কিন্তু এর বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। রোগী মারা গেলে লাশ আটকে রেখে বিল আদায় করা হয়। হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ গরিব রোগীরা পায় না; কিন্তু বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা বিল সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। মানুষের জীবনকে জিম্মি করে এরা বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছেন। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অথচ ডাক্তারি পেশাটা একটা মহান পেশা, যা অন্যসব পেশার মতো নয়। একজন অসুস্থ মানুষকে কোন রোগের জন্য কী চিকিৎসা দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলতে হবে, সেটা পড়াশোনা এবং হাতে-কলমে বা ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করলে সেই চিকিৎসক যথাযথভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারবেন না। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর মুখে পড়তে পারেন; যা বর্তমানে অহরহ ঘটছে। এ রকম একটি মহান পেশাকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে ভুয়া ডাক্তার তৈরিতে সহায়তা করেছে। এসব ভুয়া ডাক্তার দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলে যোগদান করে স্বাস্থ্য খাতের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। মানুষ কতটা অমানবিক, মনুষ্যত্বহীন, বিবেকহীন, লোভী এবং দুর্নীতিপরায়ণ হলে এ ধরনের অনৈতিক কাজ করতে পারে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, শিক্ষায় ভেজাল এটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু এবারে জানা গেল ডাক্তারি বিদ্যায় ভেজাল। ভেজালে ভেজালে সয়লাব আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তর। এসব ভেজাল সিন্ডিকেটের হোতাদের অনতিবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে ভেজালে সয়লাব হয়ে যাবে আমাদের জীবনমান। এভাবে চলতে থাকলে আমরা একসময় অসুস্থ, মানবতাবিবর্জিত, মেধাহীন জাতিতে পরিণত হব; যা কখনোই কারও জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক monjuara2006@yahoo.com