কেঁদেছিলেন গণরুমের অন্য ছাত্রীরাও


কেঁদেছিলেন গণরুমের অন্য ছাত্রীরাও
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নবীন সেই ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতনের সময় তার আর্তনাদে গণরুমে থাকা অন্য ছাত্রীরাও কেঁদে ফেলেন। অনেকে ভয়ে চুপসে যান। ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও ভয়ে এতদিন এ নিয়ে কেউ মুখ খোলেননি। তবে আস্তে আস্তে এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয়েছে ।নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ছাত্রী জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের দক্ষিণ ব্লকের ৩০৬নং কক্ষে নিজ এলাকার এক সিনিয়রের কাছে গেস্ট হিসাবে ওঠেন সেই ভুক্তভোগী ছাত্রী। হলের নেত্রীকে না জানিয়ে হলে ওঠার কারণে তাকে তোপের মুখে পড়তে হয়। বিষয়টি প্রভোস্ট পর্যন্ত গড়ালে পরদিন তার পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা বিবেচনা করে তাকে হলের গণরুমে থাকার অনুমতি দেন প্রভোস্ট। এরপর ঘটনার রাতে তাকে আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মীম ও চারুকলার হালিমা খাতুন ঊর্মির মাধ্যমে দোয়েল-১ গণরুমে ডেকে নিয়ে যান ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরা।ইসরাত জাহান মীম বলেন, অন্তরা আপু রাতে আমাকে ফোন করে তাকে গণরুমে নিয়ে যেতে বলেছে। আমি ও ঊর্মি তাকে গণরুমে রেখে চলে আসি। আমরা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত নই।অন্তরা নির্যাতনকারীদের বলেন, ‘এই মেয়েকে (ভুক্তভোগী ছাত্রী) হলে থাকতে দেওয়া যাবে না। ওর সঙ্গে এমন আচরণ করবি যাতে দুদিন পর নিজে থেকে হল ছেড়ে চলে যায়।’ নির্যাতনের একপর্যায়ে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের মরিয়মকে (ছদ্মনাম) ডেকে পাঠানো হয়। মরিয়ম গেলে তাকে বলা হয় সেই ছাত্রীকে থাপ্পড় দিতে। থাপ্পড় দিতে রাজি না হলে উলটো তাকে থাপ্পড় দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর মরিয়ম তাকে থাপ্পড় দেন। এভাবে ভুক্তভোগী সেই ছাত্রীকে মারধর শুরু হয়। এরপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের আগে পাশের অন্য গণরুমের ছাত্রীদের বলা হয়, কেউ যেন কক্ষ থেকে না বের হয়। এমনকি তাদের ওয়াশরুমেও যেতে নিষেধ করা হয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণরুমের আরেক ছাত্রী জানান, ওইদিন রাত সাড়ে ১১টা বা ১২টার দিকে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে গণরুমে নিয়ে আসা হয়। পরে তাকে চার-পাঁচজন মিলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়। এরপর শুরু হয় মারধর। ছাত্রীটির চিৎকার শুনে আমরাও ভয় পেয়ে যাই। গণরুমের অনেকেই মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমন নির্যাতন রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলে। গণরুমের এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা থাকায় নির্যাতনকারীদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে চেঁচিয়ে উঠলে নির্যাতনকারীরা সেই ছাত্রীকে নিয়ে হলের ডাইনিংয়ে চলে যায়।এ সময় ডাইনিংয়ে পড়ে থাকা একটি ময়লা গ্লাস তাকে চেঁটে পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনাটি ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক ছাত্রী দেখেন বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র।এ ঘটনার পর সকালে কাউকে না জানিয়ে ভয়ে হল ছেড়ে বাসায় চলে যান ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী। পরদিন বাবাকে নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কায় আবারও বাড়ি ফিরে যান।ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, আমাকে নির্মমভাবে মারধর করা হয়। গালাগাল করা হয়। মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। আমি তাদের কাছে মাফ চাইলেও তারা আমাকে ছাড়েনি। ভিডিও ভাইরাল করে দেবে বলেছে। আমি ভয়ে বাড়ি চলে এসেছি। এখনো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, ওষুধ খাচ্ছি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।প্রভোস্ট প্রফেসর ড. শামসুল আলম বলেন, অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে আমরা ছাড় দেব না। ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। শনিবার হল প্রশাসন বসবে। ওই রাতের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হবে। আতঙ্কে হল ছাড়ার কোনো কারণ নেই, আমরা ছাত্রীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব।১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে সাড়ে চার ঘণ্টা গণরুমে আটকে রেখে সেই ছাত্রীকে নির্যাতন করেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ কয়েকজন। ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে ঘটনা প্রকাশের পর এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন, শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আলাদা তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টও।