খুঁড়িয়ে চলছে মাতৃ ও শিশু হাসপাতাল


চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন পদে প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে রীতিমতো খুঁড়িয়ে চলছে রাজধানীর মিরপুরে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। তিন বছর আগে চালু হয় অত্যাধুনিক বিশেষায়িত এই চিকিৎসাকেন্দ্রটি। কিন্তু অদ্যাবধি চিকিৎসক-নার্সসহ মোট জনবলেন প্রায় ৭১ শতাংশ পদই শূন্য (১৬১টির বিপরীতে ১১৪টি)। এর মধ্যে ৫২ চিকিৎসক পদের ১৫টি এবং ৬০ নার্স পদের সবগুলো খালি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে জনবল এনে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে সার্বিক কার্যক্রম। ফলে রোগীর সেবাদানের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৬ সালে মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠিতে ২ দশমিক ৩ একর জমিতে প্রায় ১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে অধিদপ্তর। কিন্তু হাসপাতালসহ চারটি ভবন ছয়তলা পর্যন্ত তৈরির পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ভবনের নকশা পরিবর্তন করাসহ অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হয়। ফলে ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয় কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফের প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলা মূল হাসপাতাল ভবনের জায়গায় ১০ তলা ভবন, ১০০ শয্যার পরিবর্তে ২০০ শয্যার হাসপাতাল এবং কিছু পরিবর্তন এনে প্রকল্প পুনর্গঠন করে। তবে বছর তিনেক আগে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হলেও জনবল সংকট নিরসন করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রশাসন ইউনিটের উপপরিচালক (পারসনেল) জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জনবল সংকটে সেবাদান কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে গত সপ্তাহেও সচিব মহোদয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কিছু চিকিৎসক-নার্সকে প্রেষণে কাজ করানো হচ্ছে। আরও ১০ জন নার্স দেওয়ার আলোচনা চলছে। এই সপ্তাহের মধ্যেই রেডিওলজিস্ট নিয়োগের দুটি নিয়োগপত্র ইস্যু করা হবে। চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দেয় পিএসসি। পিএসসি জানিয়েছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে নার্সদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে চিকিৎসকও নিয়োগ দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, হাসপাতালটির অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, চিকিৎসকদের যেসব পদ শূন্য রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো-জুনিয়র কনসালটেন্টের (গাইনি অ্যান্ড অবস) তিনটি পদের দুটি, জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) তিনটি পদের সবগুলো, জুনিয়র কনসালটেন্টের (অ্যানেস্থেসিয়া) দুটি, জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং), জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (নবজাতক), জুনিয়র কনসালটেন্ট (জেনারেল সার্জারি), আবাসিক সার্জন ও আবাসিক ফিজিশিয়ানের সবগুলো পদ। এছাড়া সেবা তত্ত্বাবধায়কের একটি, সেবা উপ-তত্ত্বাবধায়কের একটি ও নার্সিং সুপারভাইজারের চারটি পদ শূন্য রয়েছে। পাশাপাশি সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৬০টি পদ থাকলেও একজনকেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পাঁচজন নার্সকে প্রেষণে এনে কাজ করানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মা ও শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে মিডওয়াইফ গুরুত্বপূর্ণ হলেও অর্গানোগ্রামে সেই পদ রাখা হয়নি। ছয়জন মিডওয়াইফ ও ১৫ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা এনে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া একটি করে যেসব পদ খালি রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান সহকারী, পুষ্টিবিদ, হেলথ এডুকেটর, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী লাইব্রেরিয়ান, সাঁট-মুদ্রাক্ষারিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, কিচেন সুপারভাইজার, ওয়ার্ড মাস্টার, রেকর্ডকিপার, লিলেনকিপার, ইনস্ট্র–মেন্ট কেয়ারটেকার এবং কার্ডিওগ্রাফার। পাশাপাশি ফার্মাসিস্টের চারটি পদের একটি, টিকিট ক্লার্কের দুটি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিও) দুটি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) চারটি এবং অফিস সহায়কের ৯টি পদের সবগুলোই শূন্য রয়েছে। চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটির বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে সাড়ে তিনশ নারী ও শিশু সেবা নিতে আসে। প্রতিদিন ২০ জনের বেশি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ডেলিভারি করানোর সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ সংকটে এক থেকে দুজন প্রসূতি সেবা পান। জনবল অভাবে রাতে ল্যাবের কার্যক্রম থাকে বন্ধ। এতে সংকটাপন্ন রোগীরা রাত্রিকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত হন। উলি­খিত হাসপাতালটিসহ রাজধানীতে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। বছরদুয়েক আগে এসব প্রতিষ্ঠানে ৯০ জন নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে লিখিত পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছে না। সংকটাপন্ন নবজাতকদের সেবায় ২০টি নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (স্ক্যান) ও শিশু বিভাগ দেখভালে মাত্র ছয়জন চিকিৎসক ও চারজন আয়া কাজ করছেন। এই ইউনিটটিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স না থাকায় বাইরের নবজাতকদের ভর্তি করা হয় না। একই কারণে বড়দের জন্য পাঁচটি আইসিইউ, একটি স্টেপডাউন, একটা ভেন্টিলেটর মেশিন চালু করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ভর্তি রোগীদের জন্য হাসপাতাল থেকে খাদ্য সরবারহও চালু হয়নি। জনবল না থাকায় হাসপাতালটির কৈশরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা (অ্যাডলোসেন্ট) কর্নারে সেবা বন্ধ রয়েছে। পুষ্টি শিক্ষা কর্নার থাকলেও পুষ্টিবিদ নেই। ভর্তি রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজনে একটি ব্লাডব্যাংক থাকলেও লোকবল সংকটে ল্যাবের প্যাথলজিস্ট ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে রক্ত সঞ্চালন করা হচ্ছে। ফ্রিজের অভাবে রক্ত ও ইপিআই টিকা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলেন, এখানে বহিঃ ও জরুরি বিভাগের মাত্র ৫ টাকার টিকিটে চিকিৎসক দেখানো যায়। ১০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায়। স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানকারী মায়েরা দৈনিক মাত্র ২০০ টাকা এবং সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তানপ্রসব করলে এককালীন ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে কেবিন সুবিধা পান। হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা আছে। দিন দিন রোগীদের উপস্থিতি বাড়ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসা কার্যক্রমের কলেবর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতাল পরিচালক ডা. রতন কুমার আগরওয়ালা বলেন, চিকিৎসক-নার্সের ঘাটতি সত্তে¡ও রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাদানের চেষ্টা করছি। অক্টোবরেই বহির্বিভাগে ৩২৪ জনকে কৈশরবান্ধব, ৩৯৯২ জনকে গাইনি অবস, ২৭ জনকে বন্ধ্যত্ব সেবা, ২০৮ জনকে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, ২৩২৫ জন শিশুর চিকিৎসা ও ৩০০ জনকে ইপিআই টিকা দিয়েছি। এ সময় ১২৫ জন গর্ভবতী নারীকে সিজার ও ৩৩ জনকে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবসেবা দিয়েছি। জনবল নিয়োগের বিষয়ে রোববার একজন অতিরিক্ত সচিব পরিদর্শন করে গেছেন। তাকে দ্রুত জনবল নিয়োগের জন্য বলেছি। এছাড়া শিগগিরই ভর্তি রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হবে।