খুলনায় ওসি আবু বকরের জমি, ৫ তলা ভবন ক্রোক


খুলনায় ওসি আবু বকরের জমি, ৫ তলা ভবন ক্রোক
খুলনার আলোচিত ওসি শেখ আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে থাকা সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার ৫ কাঠা জমিসহ বিলাসবহুল ৫ তলা বাড়ি ক্রোক করেছে দুদক। বাড়ির সামনে মঙ্গলবার ক্রোকের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে অর্জিত তাঁর অন্যান্য জমিতেও একইভাবে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অভিযোগ উঠেছে ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক ওসি আবু বকর সিদ্দিক।নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকা প্রথম ফেজের ১০ নম্বর রোডে ১৪২ নম্বর প্লটে আবু বকরের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের ক্রোক বিজ্ঞপ্তির সাইনবোর্ড ঝোলানো। এতে লেখা রয়েছে, ‘ক্রোকাবদ্ধ সম্পত্তি এবং সম্পত্তির ওপর নির্মিত ৫ তলা ভবন কোনোভাবে অন্যত্র হস্তান্তর, সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো লেনদেন, সম্পত্তি এবং সম্পত্তির ওপর নির্মিত ভবন কোনোভাবে দায়বদ্ধ করা আইনত নিষিদ্ধ।’দুদকের উপপরিচালক এম এ ওয়াদুদ জানান, জমি ও বাড়িটি সাবেক ওসি আবু বকরের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া পারুলের নামে। তাঁরা ৫ তলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় থাকেন। অন্য ৪টি তলা একটি আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার কাছে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। বাকি ৪টি তলা দ্রুত খালি করে দিতে বলা হয়েছে। এগুলো খালি করার পর রিসিভার নিয়োগের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। এরপর ভাড়া দিয়ে যে আয় হবে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শেখ আবু বকর সিদ্দিক চাকরি করেছেন খুলনার বটিয়াঘাটা থানা, খুলনা পিবিআই, চুয়াডাঙ্গা ডিএসবিসহ কমপক্ষে ১২টি স্থানে। অবসরে যাওয়া এই ওসির গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার চুলকাঠি গ্রামে। তবে সোনাডাঙ্গার বাসায় বসবাস করেন।দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর তৎকালীন ওসি আবু বকর সিদ্দিক ও তাঁর স্ত্রী পারুলের বিরুদ্ধে দুদকের খুলনার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুটি মামলা হয়। দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. আল আমীন বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। তখন আবু বকর চুয়াডাঙ্গা জেলা ডিএসবির পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৮৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আবু বকর দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ১৫৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। এ ছাড়া তাঁর জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৩৩ লাখ ৮৫৯ টাকার সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রাখেন। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা স্ত্রীর নামে দান দেখিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করেন। এই অপরাধে দুদক ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনের দুটি ধারায় এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের দুটি ধারায় মামলা করে।এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে অপর মামলায় প্রধান আসামি করা হয় পারুলকে এবং ২ নম্বর আসামি করা হয় আবু বকরকে। মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পারুল দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকার তথ্য গোপনসহ ১ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেন। স্বামী আবু বকর চাকরিতে থাকাকালে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা দান হিসেবে গ্রহণ করেন। ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে আয় দেখিয়ে বৈধ করার চেষ্টা এবং আবু বকরের দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা স্বামীর নামে দান হিসেবে দেখিয়ে বৈধকরণে সহায়তা ও স্বামীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহায়তা করার অপরাধ উল্লেখ করা হয়।মামলা হওয়ার কিছুদিন পর আবু বকর ও তাঁর স্ত্রী উচ্চ আদালত থেকে ৮ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হলে গত বছর ৫ মে তাঁরা খুলনার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাদের কারাগারে পাঠান। প্রায় ৬ মাস পর তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।দুদকের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, আবু বকরের আরও অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার জমির মূল্য ১৩ লাখ টাকা এবং বাড়ির মূল্য ৮২ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। বাড়িটি বিদেশি টাইলসসহ আধুনিক সব নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি। ওই জমি ও বাড়ির প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি। খুলনা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় প্রতি কাঠা জমির সর্বনিম্ন সরকারি মূল্য ১১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ৫ কাঠা জমির মূল্য ৫৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তবে এখন এলাকায় প্রতি কাঠা জমি ৭০ লাখ টাকায় বেচাকেনা হয়।দুদকের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, নগরীর দৌলতপুর থানার পাবলা মৌজায় আবু বকরের সাড়ে ৪ কাঠার প্লট রয়েছে। বাগেরহাট সদর উপজেলার যুগিডাঙ্গা মৌজায় ৩৯ শতক জমি, একই মৌজায় আরেকটি স্থানে ৩ দশমিক ৮৫ একর জমি রয়েছে, যা তিনি সম্পদ বিবরণীতে দেখাননি। এসবের মূল্য কয়েক কোটি টাকা। তিনি জানান, আবু বকর তাঁর ছেলেকে ৫২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কিনে দেন। কিন্তু সম্পদ বিবরণীতে তা উল্লেখ নেই। এসব জমির দলিল ও গাড়ির কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।দুদকের আইনজীবী আরও জানান, গত বছর ২৬ মে আবু বকর ও তার স্ত্রী পারুলের সম্পত্তি আইনত বাজেয়াপ্তকরণ (অ্যাটাচমেন্ট) ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালতে মামলা চলাকালীন অপ্রদর্শিত এসব সম্পদ আসামিরা যেন হস্তান্তর করতে না পারেন সে জন্য এই আবেদন জানানো হয়। ৩০ মে আদালত স্বামী-স্ত্রীর ৪টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত রাখার নির্দেশনা এবং সম্পত্তির হস্তন্তর বন্ধ রাখতে আইনত বাজেয়াপ্তকরণ (অ্যাটাচমেন্ট) নোটিশ দেয়। মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক খুলনার উপপরিচালক এম এ ওয়াদুদ জানান, আবু বকরের অন্যান্য জমিও ক্রোক করা হয়েছে, তবে সেগুলো খালি জমি। ওই জমিতেও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, আবু বকরের সাতক্ষীরায় জমি আছে কিনা এবং ঢাকায় জমি বা ফ্ল্যাট আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নগরীর একটি অভিজাত আবাসিক হোটেলে তাঁর শেয়ার থাকার গুঞ্জন রয়েছে, সে বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি খুলনার সাধারণ সম্পাদক শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, এত সম্পদ একজন ওসির পক্ষে চাকরি করে বৈধভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। সঠিক তদন্ত করে অভিযোগপত্র প্রদান এবং শাস্তি দেওয়া উচিত। তাহলে অন্যরা এ ধরনের কাজে নিরুৎসাহিত হবে। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, যার আইন রক্ষা করার দায়িত্ব তিনি আইন ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার।