ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের চিন্তা


ভাঙন ঠেকাতে দলের ‘কৌশল’ সফল হয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। চাপ ও নানা প্রলোভনে ফেলতে পারেনি নেতাদের। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হলে রাতে সিনিয়র নেতাদের ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। এ নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেন তারা। এছাড়া সরকার পদত্যাগের একদফা দাবি আদায়ে হরতাল ও অবরোধের পাশাপাশি ভিন্ন কর্মসূচিও পালন শুরু করেছে দলটি। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে দশ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করার চিন্তা করছে। গুম-খুন, সাজা, কারাবন্দি ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদেরও এ কর্মসূচিতে রাখার বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে চলতি সপ্তাহে সমমনা দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। এছাড়া গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মোট ৬০টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। এসব দলকে বিএনপির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে তাদের সঙ্গে যোগযোগ শুরু করেছে দায়িত্বশীল নেতারা। দাবি আদায়ে এক মঞ্চ কিংবা পৃথকভাবে দলগুলো যেন মাঠে সোচ্চার থাকে, সেজন্য কাজ করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সপ্তাহে তিন দিন বিরতি দিয়ে হরতাল ও অবরোধ পালনের সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। বিরতির দিনে ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে দলটি। সেক্ষেত্রে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে ১০ ডিসেম্বর রোববারের পরিবর্তে সরকারি ছুটির দিন শনিবার ৯ ডিসেম্বরও সমাবেশ হতে পারে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক কর্মসূচি নিয়েই আলোচনা করি। কাজেই শেষ পর্যন্ত কোনটা যে স্থির হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না।’ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘সমাবেশ করার বিষয়টি আমাদের চিন্তার মধ্যে আছে। দু-তিন দিনের মধ্যে এ নিয়ে আমরা বসব। সেখানেই চ‚ড়ান্ত হবে।’ একই কথা জানান ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই জানানো হবে।’ এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, নির্বাচনে নিতে কেন্দ্রীয় নেতা, দলের সাবেক সংসদ-সদস্য ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের টার্গেট করা হয়েছিল। ভয়ভীতি ও নানা প্রলোভনও দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ড থেকে সবাইকে আÍগোপনের পরাপর্শসহ নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এমন কৌশল সফল হয়েছে। বিএনপিকে ভাঙা তো দূরের কথা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতাকেই নির্বাচনে নিতে পারেনি, ভিন্ন কোনো দলেও ভেড়াতে পারেনি। ভার্চুয়াল বৈঠকে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে দুজন সিনিয়র নেতা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় হঠাৎ করে শাহজাহান ওমরকে জামিন দেওয়ার পর তারা ধরেই নিয়েছিলেন তিনি নির্বাচনে যাচ্ছেন। ওইদিন কিংস পার্টিখ্যাত একটি দলে যোগদানের গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু তাকে নৌকা প্রতীক দেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি হয়েছে। ঝালকাঠিতে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন তাদের (আ.লীগ) তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে এ বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে ভাঙার এবং বিএনপি জোট থেকে কিছু দলকে লোভ দেখিয়ে প্রহসনের নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিছু নিকৃষ্ট লোভী ছাড়া কেউ সরকারের এই হীনকর্মের সঙ্গী হয়নি। সরকার ভুঁইফোঁড় দলগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে নির্বাচনে আনার চেষ্টায় প্রমাণ হয়েছে তারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছে। এই একতরফা নির্বাচন তাদের বাঁচাতে পারবে না, তাদের নির্বাসনে পাঠাবে। যারা লোভে পড়ে সরকারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নেবেন তারা রাজনীতির আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হবেন। সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যে তাদের বেইমান হিসাবে আখ্যায়িত করেছে।’ নির্বাচন বর্জন : দলটির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জানান, তাদের হিসাবে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬০টি রাজনৈতিক দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দলগুলো হলো-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুসলিম লীগ। গণতন্ত্র মঞ্চে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন। ১২ দলীয় জোটে থাকা জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ এলডিপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা (রাশেদ প্রধান), জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ফারুক), ইসলামিক ঐক্যজোট, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা (লুৎফর), বিকল্পধারা বাংলাদেশ (নুরুল আমিন বেপারী), গণদল, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী, ডেমোক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), সমাজতান্ত্রিক মজদুর পাটি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), গণফোরাম, পিপলস পার্টি (আরেক অংশ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (আরেক অংশ), গণঅধিকার পরিষদ (রেজা), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পাটি, গণঅধিকার পরিষদ (নুর)। বাম গণতান্ত্রিক জোটের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা, গণমুক্তি ইউনিয়ন, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মাহবুব), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাসদ। ১৪ নেতা বহিষ্কার : দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এখন পর্যন্ত ১৪ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তাদের মধ্যে আটজন কেন্দ্রীয় নেতা, বাকি ছয়জন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিলেন। বহিষ্কৃত আট কেন্দ্রীয় নেতা হলেন-ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ একে একরামুজ্জামান, তাঁতীবিষয়ক সহসম্পাদক রাবেয়া সিরাজ, নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, শাহ শহীদ সারোয়ার, মতিউর রহমান মন্টু, খন্দকার আহসান হাবিব ও একেএম ফখরুল ইসলাম। এর মধ্যে রাবেয়া সিরাজ বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান শাজাহান সিরাজের স্ত্রী। টাঙ্গাইল-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন তার মেয়ে শুল্কা সিরাজ। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মেয়ের পক্ষে কাজ করছেন রাবেয়া। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বহিষ্কৃত নেতারা হলেন-শেরপুর জেলার সহদপ্তর সম্পাদক জায়েদুর রশিদ শ্যামল, সদস্য আবদুল্লাহ, পঞ্চগড় জেলার সদস্য আব্দুল আজিজ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সদস্য মাহবুবুল হাসান, ঢাকার ধামরাই পৌর বিএনপির সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন মঞ্জু ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আবদুল মতিন।