তুরস্ক-সিরিয়ায় মৃত বেড়ে ২৫ হাজার ৪০১ জন রাস্তায় রাস্তায় শববাহী গাড়ির জট


তুরস্ক-সিরিয়ায় মৃত বেড়ে ২৫ হাজার ৪০১ জন রাস্তায় রাস্তায় শববাহী গাড়ির জট
রাস্তাগুলো এবড়ো-খেবড়ো। পিচ-পাথরে মোড়ানো উপরের মসৃণ চল্টা ছিটকে পড়েছে। ছোট-বড় সব সড়কের একই দশা। জায়গায় জায়গায় খাবলা খাবলা নেই। ভঙ্গুর-বন্ধুর ওই পথ ধরেই গন্তব্যে ছুটছে ত্রানবাহী লরি। শববাহী গাড়ি। একটা-দুটো নয়। ডজন ডজন।কোনো কোনো সড়কে শতেক ছুঁই। একে রাস্তা খারাপ, পথ এগোচ্ছে না। তার উপর ধ্বংসস্তূপগুলো থেকে কিছুক্ষণ পরপরই ছুটে আসছে লাশবাহী গাড়ি। তৈরি হচ্ছে লম্বা জ্যাম। কখনও আধা ঘণ্টা।কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু মরদেহবাহী গাড়িগুলো যাচ্ছে কোথায়? প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ংকর এক সত্য। হাসপাতালের মর্গগুলোতে আর লাশ রাখার জায়গা নেই। পারিবারিক-সরকারি প্রায় সব কবরস্থানই ভরে গেছে। এখন পরিত্যক্ত ভূমি, ফসলের মাঠে সমাধির ব্যবস্থা করছে স্থানীয় প্রশাসন।শনিবার এক প্রতিবেদনে হাতায় প্রদেশের এমনই একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছে এএফপি। শুধু তুরস্ক নয়, প্রায় একই অবস্থা সিরিয়ার আলেপ্পোতেও। সোমবার ৭.৮ মাত্রায় তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পের ষষ্ঠ দিন শনিবার মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪০১ জনে।হাতায় প্রদেশের আনতাক্যা শহরের গম আর তুলা চাষের জমিতে দাফন করা হচ্ছে শত শত লাশ। শুধু শুক্রবারেই আন্তাকায়াসহ পুরো হাতায়ে ৫ হাজার মৃতের ৬০০ জনকেই দাফন করা হয় এখানে।কবরের পাশেই এক অপরকে আলিঙ্গন করে কাঁদছেন স্বজনেরা আর স্বেচ্ছাসেবীরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের। আন্তাকিয়ার দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ লাশবাহী গাড়িতে। তখনই কালো ব্যাগে মোড়া একটি সাদা লাশবাহী গাড়ি আসে। পাশেই সদ্য খনন করা কবরে প্রতিটি লাশ নামাতে কাজ করছেন ছয়জন।পাশ থেকেই একজন আর্তনাদ করে উঠেন, ১ মিনিট অপেক্ষা কর। একটি নামই বলছিলেন বারবার-‘এমিন’। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃতদেহগুলো চাপা পড়ে যায় মাটিতে। স্প্রে পেইন্ট করে কবরের অস্থায়ী নামফলক দেওয়া হয় ’৯৪, ৯৫, ৯৬ ও ৯৭’ নামে।চারটি নামফলকেই শেষ নয়। একের পর এক আসতেই থাকে মৃতদেহ। সংকট পড়ে যায় লাশবাহী ভ্যানের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাতেও। মৃতদেহ বহন করতে এই গাড়িগুলো আনা হয়েছে দক্ষিণে আন্টালিয়া প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিমের বুর্সা, এমনকি হাতায় ১৪ ঘণ্টা দূরের উত্তর-পূর্বে কারসসহ পুরো তুরস্ক থেকে। শনাক্ত মৃতের মৃত্যুসনদে স্বাক্ষর করতে ভাঁজ করা টেবিলের কাছে স্বজনের অপেক্ষায় ১৫ জন।অথচ তখনও মৃতের খোঁজ নিতে আসছেন না কেউ। এই টেবিলের পাশেই ক্লান্ত মুখে বসে আছেন ইউসুফ উজকান নামে এক ইমাম। হাতায় প্রদেশের ৯০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন তিনি। জানান, জানাজা দিতে পুরো তুরস্ক থেকে হাতায়ে ইমাম পাঠানো হয়েছে ৪০০ জন।এ পর্যন্ত কতটি জানাজার নামাজ পড়েছেন সে হিসাবও নেই তার। মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারণ করেন, ‘অনেক।’ রাস্তার ঠিক বিপরীত পাশেই ২০০ কিলোমিটার দূরের অস্থায়ী কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে ভূমিকম্পে ঘর হারানো এক দেনিজ পরিবার। দশ মিটারের তাঁবুতে থাকা এই পরিবার আগমনী দেখছে লাশবাহী ভ্যান ও খননকারীদের।৩৫ বছর বয়সি কামাল দেনিজ জানান, তারা ভেবেছিলেন, গভর্নর ও কর্মকর্তারা জমি নিতে আসেন বেঁচে থাকাদের জন্য তাঁবু বানতে। এক মিস্ত্রি জানান, কিন্তু গম ও তুলা চাষের এই জমি এখন পরিণত হয়েছে গোরস্থানে। প্রতিদিন এই দৃশ্য দেখা তাদের জন্য কঠিন। কিন্তু এছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি।মৃতদেহের প্রবল দুর্গন্ধ এড়াতে কালো কোট, নীল ভেস্ট ও হাতে গ্লাভস ও সার্জিক্যাল মাস্ক পরে আছেন। ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়ারা আছেন আরও বড় কষ্টে। ঘুম ভাঙলেই মৃত্যুর খবর। সারা দিন হন্যে হয়ে স্বজন খোঁজা। দুমুঠো খাবারের জন্য ২ ঘণ্টার লম্বা লাইন। বিষাদক্লিষ্ট শরীর নিয়ে দিন শেষে তাঁবুতে ফেরা। ভূমিকম্পের দিন থেকে এমনই ছিল তুরস্ক-সিরিয়ার গাজিয়ানতেপ থেকে আলেপ্পোর দৈনন্দিন চিত্র।কিন্তু এখন অনেকটাই বদলে গেছে সে দৃশ্য। প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশার ঘরে জমেছে হতাশার আক্ষেপ। বাড়ছে ক্ষোভ। সময়মতো খাবার-কম্বল না পাওয়ার ক্ষোভ। বৈরী আবহাওয়ার অসিলায় মন্থর উদ্ধার অভিযানে ক্ষোভ। জনবল, সরঞ্জাম সংকটের ওপর ক্ষোভ। আর এসব রাগ একসঙ্গে, দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুদেশের সরকারপ্রধানের ওপর।তুর্কিরা খ্যাপেছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানে। সিরীয়রা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদে। জনঅসন্তোষের মুখে উদ্ধার অভিযানেও এসেছে জোর গতি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুদেশে এখন ৬৮ দেশের উদ্ধারকারী দল। মরিয়া হয়ে উদ্ধার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ৮ হাজার ৩২৬ জন বিদেশি উদ্ধারকারী।কয়েকদিনের মধ্যেই এই দলে আরও ১৫ হাজার ৬৩ জন বিদেশি উদ্ধারকারী যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এক কথায় তুরস্ক-সিরিয়ার এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগিয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশই। সুপ্রশিক্ষিত একটি উদ্ধারকারী দল গেছে বাংলাদেশ থেকেও।