দলনেতা নারী হলেও বাড়ছে না প্রতিনিধিত্ব
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পদে নারী হলেও সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব আনা সম্ভব হয়নি। জনশুমারির হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। তিন দশক ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু নারীর প্রতিনিধিত্ব আশানুরূপ বাড়ছে না। রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্তানুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের মধ্যে এই শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করে ৩৯টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পায়। নির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার পরে আরও ১০ বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু ইসি ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি ও দফায় দফায় বৈঠকে এরই মধ্যে দুই বছর পেরিয়ে গেছে। অবশেষে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশ্লিষ্ট এই ধারা সংশোধন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাবে দুই পক্ষ একমত হয়েছে বলে জানা গেছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির শর্ত ২০৩০ সালেও পূরণ করা সম্ভব হবে না। এখনও কোনো দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেই ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতে নারীর অবস্থান আরও কম। এমনকি জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনেও নারী প্রতিনিধিত্ব তেমন বাড়ছে না। শুধু নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদগুলো পূরণ হচ্ছে। সেখানেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা আছে, ইসির নিবন্ধন পেতে রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্রসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে নারীর জন্য কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।২০০৮ সালে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে নারী নেতৃত্বের হার ছিল গড়ে ১০ শতাংশ। ওই সময় আরপিও সংশোধন করে ২০২০ সালের মধ্যে দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার বিধান চালু হয়। তবে শুরু থেকেই নিবন্ধন আইনের এ শর্তটির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল একাধিক ধর্মীয় দল। সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন আয়োজিত সংলাপেও একাধিক ধর্মভিত্তিক দল নিবন্ধনের এই ধারা বাতিলের পক্ষে মত দেয়। যদিও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বাম দলগুলো নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির পক্ষে।বর্তমানে দেশের অন্যতম তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির প্রধান রওশন এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে আছেন। নব্বইয়ের পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বও ঘুরেফিরে তাঁদের হাতেই। বর্তমানে সংসদের স্পিকার, সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা নারী। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যেও নারীর উপস্থিতি রয়েছে।রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়ার কারণ সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদ্যমান সংরক্ষণ পদ্ধতি মূল কারণ। জাতীয় সংসদের নারী আসনসহ স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত পদগুলোতে যোগ্যদের আনা হয় না। এটা বর্তমানে আলংকারিক অবস্থায় রয়েছে। নানা তদবির ও দেনদরবারের বিনিময়ে এসব পদ পূরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এই সংরক্ষণ পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, সংসদ ও স্থানীয় সরকারে সংরক্ষণ পদ্ধতি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এতে নারীর প্রতিনিধিত্ব মূলত প্রতীকী। সংরক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে উত্তম পদ্ধতি হতে পারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি, যা ভারতের পঞ্চায়েত প্রথায় বিরাজমান। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব আসন থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের শর্ত পূরণ না হওয়ার পেছনে ইসির আন্তরিকতার অভাব ছিল। কারণ, তারা বিষয়টি নিয়মিত মনিটর করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করেনি।তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে আন্তরিকভাবে নেওয়া হয় না। এটি পুরুষশাসিত সমাজের মানসিক দৈন্য। সব রাজনৈতিক দল তাদের সভা-সমাবেশ-মিছিলে নারীদের ব্যবহার করে; কিন্তু নেতৃত্বে বসানোর ক্ষেত্রে উদারতা দেখাতে পারে না।রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, যোগ্য নারী নেতৃত্ব পাওয়া যায় না– এ বক্তব্যের জবাবে মালেকা বানু বলেন, সব পুরুষ নেতৃত্ব কি যোগ্য? তাঁর মতে, সংসদের সংরক্ষিত আসনগুলো প্রয়াত এমপির বোন বা স্ত্রীকে ওই দলের মনোনীত করে কোটা পূরণ করা হয়। স্থানীয় সরকারের মতো সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের দাবি জানান তিনি।জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, তিনি নিজেই শুরুতে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। পরে সরাসরি আসনের এমপি হয়ে স্পিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি দেশের আর্থসামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই নারীরা সমাজের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। গত কয়েক দশকে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন অংশে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ধরনের উদ্যোগের ফলে নারীদের অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান। রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব ৩৩ শতাংশ পূরণ হয়নি বলেই নারীরা সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে– এটা ভাবার সুযোগ নেই।ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩ নারী সরাসরি এমপি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। অর্থাৎ বর্তমানে মাত্র ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ নারী এমপি সরাসরি নির্বাচিত হয়েছেন। সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন যুক্ত করলে নারী নেতৃত্ব দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। নির্বাচিত ২৩ এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০ জন, জাতীয় পার্টির দু’জন ও জাসদের একজন।দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নারী মাত্র একজন। এসব সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড সদস্যের ৪৭৬টি পদের বিপরীতে নারী রয়েছেন মাত্র দু’জন। অবশ্য সিটি করপোরেশনে সংরক্ষিত সাধারণ ওয়ার্ডে ১৬০ নারী রয়েছেন। জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৬১ জনের মধ্যেও নারী রয়েছেন মাত্র একজন। উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৪৯২ জনের মধ্যে নারী রয়েছেন আটজন।দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান পদে নারীর সংখ্যা হাতেগোনা। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে ৪ হাজার ৫৮ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে নারী বিজয়ী হয়েছিলেন মাত্র ৪৬ জন। এর আগে ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৭৮ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে নারী ছিলেন ২৬ জন।ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে সর্বশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশে পৌঁছেছে। দলটির ৮১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে দুটি পদ শূন্য রয়েছে। ৭৯টি পদের বিপরীতে নারী রয়েছেন ২০ জন। অবশ্য ২০০৮ সালে দলটি যখন ইসির নিবন্ধন পায়, তখন নারী নেতৃত্ব ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। সে হিসাবে দেড় দশকে দলটির নারী নেতৃত্বের বৃদ্ধির হার দ্বিগুণের বেশি।আওয়ামী লীগের ২০ জনের মধ্যে সভাপতি শেখ হাসিনা, সভাপতিমণ্ডলীতে ৩ জন, সম্পাদকমণ্ডলীতে ৭ জন ও কেন্দ্রীয় সদস্যপদে ৯ জন নারী রয়েছেন। আওয়ামী লীগের ৪৫ জন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যের মধ্যে নারী রয়েছেন মাত্র ৫ জন।বিএনপির ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটির মধ্যে নারী ৬৭ জন, অর্থাৎ ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। দলটির উপদেষ্টা পরিষদে ৮২ জনের মধ্যে নারী ৬ জন। বিএনপির ১৫ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে তৃণমূলে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টিতে ২০ শতাংশ নারী রয়েছে বলে দলটি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে বেশ আগেই দাবি করে আসছে।
