দুর্ঘটনায় জীবনের ক্ষতিও আপসযোগ্য হচ্ছে


দুর্ঘটনায় জীবনের ক্ষতিও আপসযোগ্য হচ্ছে
বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় জীবনের ক্ষতির পরও আপস-মীমাংসায় নিষ্পত্তির সুযোগ পেতে যাচ্ছেন পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকেরা। এ প্রক্রিয়া সফল হলে দুর্ঘটনার এ অপরাধের সাজা থেকে রেহাই পাবেন তারা।পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের এমন সুযোগ দিয়ে সংশোধন হতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮। যদিও বিদ্যমান আইনে এ অপরাধটি জামিন অযোগ্য এবং এর সাজা সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে ৯৮ ও ১১৭ নম্বর ধারাসহ বিদ্যমান আইনের অন্তত ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।সূত্র আরও জানায়, আইনের খসড়া সংশোধনীতে কয়েকটি ধারা সাজার পরিমাণ শিথিল করা হয়েছে। আবার আপসের সুযোগ রয়েছে এমন কয়েকটি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই ধারাগুলোর অপরাধ আর আপসযোগ্য থাকবে না। সেখানে আইনে উল্লিখিত সাজা কার্যকর হবে।সংশ্লিষ্টরা জানান, এ সংশোধনী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন পেলে তা পাশের জন্য পরবর্তী প্রক্রিয়ায় যাবে। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা যাওয়া সংক্রান্ত অপরাধের (১০৫ নম্বর ধারা) সাজায় কোনো সংশোধনী আনা হচ্ছে না। এ ধারায় অপরাধ জামিন অযোগ্য এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ জরিমানার যে বিধান রয়েছে তা বহাল রাখা হচ্ছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী জানান, সড়ক পরিবহণ আইনের কয়েকটি ধারা-উপধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে।মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে এ আইন সংশোধন করা হচ্ছে কি না-এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, তিনজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি এ আইন সংশোধনের বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। ওই সুপারিশের আলোকে সংশোধনী প্রস্তাব করা হচ্ছে।তবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের দাবি, এর মধ্য দিয়ে মালিক-শ্রমিক নেতাদের দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। এতে সড়ক নিরাপদের পরিবর্তে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বিদ্যমান আইনে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। যদি আইন সংশোধন করতে হয় তাহলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পৃথক অধ্যায় যুক্ত হওয়া উচিত। অথবা এ সংক্রান্ত আলাদা আইন প্রণয়ন করা দরকার। কিন্তু তা না করে বিপরীত ধরনের সংশোধন করা হচ্ছে।সংশ্লিষ্টরা জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক পরিবহণ আইন পাশ হয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর এক বছরের বেশি সময়ের পর ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর তা কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়। আর এ সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করা হয় গত জানুয়ারি মাসে। পরিবহণ নেতাদের দাবির মুখে এ আইনের সব ধারা এখনও পুরোপুরি প্রয়োগ হচ্ছে না। এরই মধ্যে আবার আইনটি সংশোধনের জন্য সংসদে যাচ্ছে।সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহণ আইনের অন্তত নয়টি ধারা নিয়ে আপত্তি ছিল পরিবহণ নেতাদের। বিষয়টি তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে উপস্থাপনও করেন। ওই ধারাগুলো হচ্ছে-৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯৮ ও ১০৫। তাদের আপত্তির মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এ আইন সংশোধনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে।এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। সেগুলোর সমন্বয়ে আইনের সংশোধনী প্রস্তাব করা হচ্ছে। ওই প্রস্তাবে পরিবহণ নেতাদের আপত্তি জানানো কয়েকটি ধারারও সংশোধনীতে রয়েছে। তবে অন্য যেসব ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা হচ্ছে তার একটি ৯৮ ও ১১৭ নম্বর ধারা। ৯৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়াভাব, ওভারটেকিং, ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীন মোটরযান চালানোর ফলে কোনো দুর্ঘটনায় জীবন বা সম্পত্তির ক্ষতি হয়, তা হলে মোটরযানের চালক বা কন্ডাক্টর বা সহায়তাকারী ব্যক্তির অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দিতে পারবেন। আইনের ১১৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে ৯৮ নম্বর ধারাটি জামিন অযোগ্য হবে।সংশোধনী প্রস্তাবে ৯৮ নম্বর ধারাটি জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য করা হচ্ছে। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা আপস করতে পারলে তিনি সাজা এড়ানোর সুযোগ পাবেন। তবে ৮৪ নম্বর ধারাটি জামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।এ ধারায় বলা আছে, অনুমতি ছাড়া গাড়ির কারিগরি, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। বর্তমান আইনে ধারাটি জামিন অযোগ্য হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। সেটি সংশোধন করে জামিনযোগ্য হিসাবে প্রস্তাব করা হচ্ছে।নকল, ভুয়া ও জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি ও ব্যবহার করার অপরাধে ৬৯ নম্বর ধারায় সর্বনিম্ন ছয় মাস ও সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম এক লাখ ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সংশোধনীতে জরিমানার টাকা কমিয়ে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।ধারা-৬ এ তিন চাকার যন্ত্রচালিত যানবাহনে চালকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ থাকতে হবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে তা শিথিল করে পঞ্চম শ্রেণি করা যাবে। এ ছাড়া আইনের সংজ্ঞায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। এতে যানবাহনের শ্রেণিবিন্যাসেও সংশোধন আসছে।সংজ্ঞায় ভারী যানবাহনের ওজন ১২ হাজার কেজি থেকে কমিয়ে ৭৫০১ কেজি নির্ধারণ করা হচ্ছে। মধ্যম যানবাহনের ওজন সাত হাজার কেজি থেকে কমিয়ে সর্বনিম্ন তিন হাজার ৫০১ কেজি নির্ধারণ করা হচ্ছে। ওজন অনুপাতে গাড়ির নিবন্ধন, চালক নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয় নির্ধারিত হবে।সংশোধীনতে সুপারভাইজারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি ও কন্ডাকটরের যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। পণ্যবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে এজেন্টদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে কোনো এজেন্ট গাড়ি বন্দোবস্ত নিয়ে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ করালে তিনিও সাজার আওতায় আসবেন। সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুয়েকটি ছাড়া বাকি সংশোধনীর মাধ্যমে আইন আরও স্পষ্ট ও কঠোর করা হচ্ছে।