দুর্নীতি, অর্থ পাচার নিয়ে মাসজুড়ে আলোচনা


দুর্নীতি, অর্থ পাচার নিয়ে মাসজুড়ে আলোচনা
জাতীয় সংসদের সদ্যসমাপ্ত অধিবেশনের পুরো সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল বিদেশে অর্থ পাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটসহ নানান বিষয়। ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার অসম চুক্তি, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও ব্যয় বাড়ানো বিষয়ে আলোচনা হয়। উঠে আসে খেলাপি ঋণ, ব্যাংকে তারল্য সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, শেয়ারবাজারে কারসাজি, আমলাতন্ত্রের দাপট, দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়।আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দখল-চাঁদাবাজি, সড়ক দুর্ঘটনা, বেহাল সড়ক-মহাসড়ক এবং পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসংগতি নিয়েও সংসদে বক্তৃতা চলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বায়ুদূষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধী দলের সদস্যরা আলোচনা করেন।মূলত রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব এবং বিল পাশের সময় আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, গণফোরাম এবং স্বতন্ত্র সদস্যরাই এসব ইস্যুতে ছিলেন সোচ্চার। সরকারের সমালোচনায় সরব ভূমিকা পালন করেন তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্যদেরও কেউ কেউ ক্ষমতার চার বছরের মেয়াদ পার করে এসে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান আলোচনায় অংশ নিয়ে। আমলাতন্ত্রের দাপটে তারা জনপ্রতিনিধি হিসাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না-এমন অভিযোগও করেন শাসকদলের একাধিক সংসদ-সদস্য। যদিও এবারের অধিবেশন শুরুর আগেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন বিএনপির সাত সংসদ-সদস্য। তবে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের সরব উপস্থিতির কারণে তাদের এই অনুপস্থিতি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।নতুন বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশন শুরু হয়। ২৬ কার্যদিবসের দীর্ঘ এই অধিবেশন শেষ হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। বছরের প্রথম অধিবেশন হওয়ায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে ওইদিনই জাতীয় সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।এরপর তার ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী। এই প্রস্তাবের ওপর ৪০ ঘণ্টা ২৭ মিনিট আলোচনা হয়। সরকার ও বিরোধী দলের ২০৯ জন সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে সর্বসম্মতিতে ধন্যবাদ প্রস্তাবটি গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ। এর বাইরে প্রশ্নোত্তরপর্ব ছাড়াও ১১টি আইন পাশ হয় সদ্যসমাপ্ত অধিবেশনটিতে।রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ অধিবেশনের সমাপন দিনে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতি, লুটপাট এবং অর্থ পাচার দেশের উন্নয়নে বড় বাধা। তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে বলেন।জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানোর সমালোচনা করেন। তিনি ঢাকার ওপর চাপ কমানো এবং বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়েও কথা বলেন জাতীয় সংসদে।একই দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার অসম চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, কার স্বার্থে এই চুক্তি করা হয়েছে, তা দেশের মানুষ জানতে চায়। সড়ক দুর্ঘটনা, সড়ক-মহাসড়কে অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৪ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কের ভোগান্তি কবে দূর হবে, কেউ জানেন না। পাঠ্যবইয়ে অসংগতি নিয়েও কথা বলেন তিনি সংসদে বিল পাশের সময়।সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, দেশে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারলে বর্তমান সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।তিনি খেলাপি ঋণ নিয়েও কথা বলেন। ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনাসহ তাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। একই দলের সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই। কয়েকটি পরিবারের লোকজন নিজেরা ভাগাভাগি করে ব্যাংক লুটপাট করছে। লুটের টাকা তারা বিদেশে পাচার করছে। শেয়ারবাজারে কারসাজি, দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও কথা বলেন তিনি।একই দলের সংসদ-সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। লুটেরার সংখ্যা বাড়ছে। রিজার্ভ কমছে। বেকারত্ব বাড়ছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট হচ্ছে-লাগাম টানার কেউ নেই। জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার দুর্নীতির অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে আমলাদের প্রভাব নিয়েও কথা বলেন তিনি। বলেন, সরকার সব ক্ষেত্রে আমলানির্ভর হয়ে গেছে।আমলাতন্ত্রের দাপটের কাছে নিজেরা অসহায়-রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে এমন অভিযোগ করেন খোদ সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য দবিরুল ইসলাম। তিনি জানান, জনপ্রতিনিধি হিসাবে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। সব ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।সরকারি দলের একাধিক সদস্য বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে বরাদ্দ না পাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়া, নদীভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সমালোচনা করেন।সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় সরব ছিলেন বিরোধী দল গণফোরামের সংসদ-সদস্য মোকাব্বির খান। তিনি বলেন, এদেশ থেকে টাকা পাচার করে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা বিদেশে সম্পদ গড়ছেন। কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কিনছেন। অন্যান্য দেশেও তারা সম্পদ পাচার করছেন, সেকেন্ড হোম করছেন।বাংলাদেশসহ বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর ২০২১ ও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনগুলো ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতেও লাগাম টানা হয় এ কারণে। সিনিয়র, বয়স্ক এবং অসুস্থ সংসদ-সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয় বিগত দুই বছর। অধিবেশনের কার্যক্রমও সীমিত রাখা হয়।সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সে ফ নিয়মরক্ষার ওই অধিবেশনগুলোয় কয়েকটি বিল পাশ হয়। এর বাইরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীসহ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনাও হয়। এবারের চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি এবং নানা বিষয়ে ঝাঁজালো আলোচনার কারণে একাদশ অধিবেশন প্রাণ ফিরে পায় পুরোদমে।