দুর্নীতি হয়রানি প্রতিরোধসহ সেবার মান বাড়ানোর কোনো কথা নেই
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল মাঠ প্রশাসনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানি প্রতিরোধে ডিসিরা কঠোর নির্দেশনা চাইবেন।এছাড়া জনগণের দোরগোড়ায় সরকারের নানামুখী সেবা হয়রানিমুক্তভাবে পৌঁছে দিতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করবেন। কিন্তু তাদের দেওয়া ২৪৫টি প্রস্তাবের কোথাও এ ধরনের বিষয় না থাকায় অনেকে হতাশ হয়েছেন। এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, জনপ্রতিনিধি ও সেবপ্রার্থীদের অনেকে।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ডিসিরা তিক্ত সত্য কখনো বলবে না। তারা সব সময় কর্তৃপক্ষের মন-মর্জির দিকে লক্ষ করে কথা বলেন।’তিনি বলেন, ‘ডিসি জেলা পর্যায়ে ১২০টি কমিটির সভাপতি। সুতরাং তারা জানেন না এমন কোনো বিষয় নেই। অথচ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন।’২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি তিনদিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৬৪ জেলার ডিসিদের পাঠানো প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে আলোচনার জন্য প্রায় আড়াইশ প্রস্তাব কার্যপত্রে যুক্ত করা হয়।বিশ্লেষকদের কয়েকজন জানান, ডিসিরা উন্নয়নসংক্রান্ত বেশকিছু ভালো প্রস্তাব করেছেন। তবে তাদের প্রস্তাবে দুর্নীতি, কৃচ্ছ সাধন এবং জনসেবা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব ছিল না। জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন থেকে দুর্নীতি ও হয়রানির বিশ্বাসযোগ্য বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।বিশেষ করে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা বিতরণ, গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা), অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন প্রভৃতি বিষয় উল্লেখযোগ্য। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুর্নীতির দায়ে বিভাগীয় মামলায় ইতোমধ্যে কয়েকজনের শাস্তিও হয়েছে। অথচ ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি প্রতিরোধে তারা কোনো কথা বলেননি।সরকারি সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া ডিসিদের কাজ। সেবাগ্রহীতাদের হাজারো অভিযোগ জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সেবা দেওয়ার নামে পদে পদে সাধারণ জনগণকে হয়রানি করা হয়।জম্মনিবন্ধন সনদ, ভূমি অফিসে নামজারি, খাজনা পরিশোধ, সব ধরনের ভাতা বিতরণ, অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, খাসজমি একসনা বন্দোবস্ত, পরিত্যক্ত সম্পত্তির লিজ নবায়ন, হাটবাজার ইজারাসহ বেশির ভাগ সেবা প্রদানে হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগ সেবাপ্রত্যাশীদের। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে হয়রানি কমিয়ে সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপের প্রস্তাব বা ঘোষণা আসেনি।এছাড়া জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনিবার্য প্রটোকলের বাইরে অপ্রয়োজনীয় প্রটোকলে ব্যস্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের।জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে ডিসিদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকা উচিত ছিল। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ডিসিদের প্রস্তাবে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য থাকবে-এটাই সবার প্রত্যাশা ছিল। জনগণের সেবক হিসাবে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রস্তাব দিলে ডিসি সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যেত।’সরকারি চাকরির বিধিবিধানসংক্রান্ত বইয়ের লেখক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আসতে হবে। এটা তাদের দায়িত্ব। নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানো কিংবা চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব আসা অনুচিত। দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে তারা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবেন। জনসেবা নিশ্চিত করাও তাদের কর্তব্য।’তিনি মনে করেন, ‘জনস্বার্থ ও সেবাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না আসা দুঃখজনক।’উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) দিয়ে ডিসিরা রাজনীতিবিদদের পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তারা যে প্রজাতন্ত্রের চাকর, বিষয়টি বেমালুম ভুলে যান।’ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও চাঁদপুরের বাগাদি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক মনোভাব এখনো বহাল। অনেক সময় তারা প্রভুসুলভ আচরণ করেন।’ এসব অভিযোগের বিষয়ে পক্ষ থেকে ডিসিদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা কথা বলতে চাননি।লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আইন ও বিধির মধ্য থেকে দায়িত্ব পালন করছি। একজন ডিসি সার্বক্ষণিক দায়িত্বের মধ্যে থাকেন। এছাড়া সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের কেউ টাই-স্যুট, প্যান্ট কিংবা লুঙ্গি পরে অথবা খালি পায়ে আসুক না কেন, আমার দায়িত্ব তার আইনগত সেবা দেওয়া। আমরা তা করছি।’অপ্রয়োজনীয় প্রটোকল ডিউটির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডিসি হিসাবে যাদের প্রটোকল দেওয়া দায়িত্ব, সেটি একধরনের প্রাধিকারের বিষয়। এটি রাষ্ট্রাচার।’নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডিসি জানান, ‘একজন ডিসিকে শুক্র, শনিবারসহ গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি মিটিং করা লাগে। কাজের চাপে পারিবারিক জীবন বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ৫৫০ ধরনের সেবা দিতে হয় জেলা প্রশাসনকে। তবে ভুলত্রুটি মানুষ হিসাবে থাকবেই। কিন্তু সব কাজ ডিসিকে করতে হবে কেন। দুর্র্নীতি দমন কমিশন আছে। তারা যেখানে দুর্নীতি পাবে, সেখানে হানা দেবে। এছাড়া দুর্নীতির ঘটনা নজরে এলে আমরা তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে লিখিত আকারে অবহিত করি এবং করাটা ডিসির দায়িত্ব।’প্রসঙ্গত, ডিসিদের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে নতুন প্রজম্মের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ, মানবিক মূল্যবোধের মানুষ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে সব উপজেলায় একটি করে পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করা, ১৮৭৯ সালের টাউট আইনের কিছু কিছু ধারা হালনাগাদ করে অর্থ ও কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়নো প্রভৃতি।এর মধ্যে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সমস্যা ও উন্নয়নসংক্রান্ত প্রস্তাব ১৩৫টি, জেলা ও উপজেলার সমস্যা সংবলিত প্রস্তাব ৭৯টি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা প্রদানসংক্রান্ত প্রস্তাব ৯টি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিসিদের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব ১২টি, বেশ কয়েকটি আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করার প্রস্তাব ৯টি এবং শিক্ষকদের আচরণবিধিমালা তৈরির প্রস্তাব ছিল একটি।
