নির্বাচন তো হলো, এখন প্রত্যাশা সুশাসন


ভালো-মন্দ যাই হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের বৈতরণি তো পার হলেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতর আলোচনা-সমালোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সুধীজনদের নিয়ে অনর্গল তর্কবিতর্কের আয়োজন করে চলেছে। আমরা যারা নিয়মিত শ্রোতা, তারা এসব শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলেছি, কোন আলোচক কী বলবেন বা আগে কী বলেছেন। এর কারণ হলো, নির্বাচন নিয়ে কতগুলো বাধাধরা কথা ছাড়া নতুন কিছু বলার থাকে না। এছাড়া দর্শক-শ্রোতাদের সবারই জানা আলোচকদের অধিকাংশই আদর্শগত দিক দিয়ে মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত এবং তাদের বিপরীতমুখী চিন্তা কখনোই এক ধারায় মিশবে না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের সহযোগী দলগুলো দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের এবং প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে যে আন্দোলন করে আসছিল এবং যা প্রায় শেষ অবধি শান্তিপূর্ণ ছিল, তা সম্ভবত লন্ডনে অবস্থিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার অনড় অবস্থানের জন্যই ভেস্তে গেছে। তার ইচ্ছা ছিল, আগে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি জিতুক, তখন তিনি ঢাকায় আসবেন এবং সব সাজা থেকে নিজেকে মুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসবেন। তবে সে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। নির্বাচন একতরফা হয়েছে এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক হয়নি-এ ব্যাপারে সমালোচকরা ঢালাওভাবে সরকারি দলকে যে দায়ী করেন, তার কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না। কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি এবং সহযোগী দলগুলোর আন্দোলন সাফল্যে রূপ নেয়নি। তার ফলে তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সবারই জানা কেয়ারটেকার বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে আন্দোলন, সেটা অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সংবিধানের আলোকে বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের দেশে একটা ধারণা বদ্ধমূল করা হয়েছে, কোনো দলীয় সরকারে অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। এটি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সততা, নিষ্ঠা এবং যোগ্যতা সম্পর্কে দেশবাসীকে কী বার্তা দেয়? পৃথিবীর সর্বত্রই তো পার্লামেন্টারি সিস্টেমে দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আর আমরা গর্বিত বাঙালি সন্তানরা, যারা বুদ্ধির বড়াই করি, তারা এতই অপদার্থ হয়ে গেলাম, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে মিলে সৎ এবং যোগ্যতার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে না। বর্তমানে যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ সর্বক্ষেত্রে সমাজকে গ্রাস করেছে, সেজন্য এককভাবে রাজনীতিকরাই দায়ী। আমাদের রাজনীতিকদের দুর্নীতির হাতেখড়ি করাই হয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পরপর তাদের বিনা শুল্কে দামি গাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সেই গাড়ি তারা ধনীদের কাছে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করে লাভবান হন। এ সুযোগ সভ্যসমাজে শুধু বিদেশে কর্মরত কূটনীতিকরাই ভোগ করে থাকেন। এদেশে কোনো সরকারই এটিকে অযৌক্তিক বা আইনসম্মত নয় বিবেচনায় নিয়ে বাতিল করেনি। আমাদের গণমাধ্যমে একটি কথা সব সময় আলোচিত হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের সমাজ দুভাগে বিভক্ত। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, যারা বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি স্তম্ভে-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত ও ধর্মনিরপেক্ষতা-পুরোপুরি বিশ্বাস করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে মান্য করেন; অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ও সমর্থকরা সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভে বিশ্বাস করেন না। তারা তাদের রাজনৈতিক দলের স্থপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক গঠনতন্ত্রের চার স্তম্ভের কাটাছেঁড়া অবয়বের সমর্থক এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে গ্রহণে তাদের দ্বিধা। এখন পঞ্চমবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সামরিক শাসনামলে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গঠনতন্ত্রকে কাটাছেঁড়া ও বিকৃত করা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ বাতিল করে মূল গঠনতন্ত্রে ফিরে যাওয়া এবং আমাদের সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ রূপটি ফিরিয়ে আনা, যেটি বর্তমানে একেবারেই উবে গেছে বললে ভুল হবে না। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে বোঝা যাবে না যে, আমি ষাট দশকে বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) যে ধর্মনিরপেক্ষ, উদার রূপটি দেখেছিলাম সেটি এখন অক্ষুণ্ন আছে। আমি তরুণ বয়সে আমাদের দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে যে উৎসাহ এবং এর প্রসার দেখেছি তা আজকাল নেই বললেই চলে। তখন আমরা নিয়মিত কবিতা পাঠের আসর এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি। পাড়ায় পাড়ায় নাটক মঞ্চস্থ হতো। রাতভর ভজন-কীর্তন-কাওয়ালি হতো। এখন সেসবের পাট চুকে গেছে। আমরা ছাত্রজীবনে মোটা মোটা বই, যেমন শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ কিংবা বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ কিনে পড়েছি। ২০২২ সালে আমার ৫২৭ পাতার বই ‘কখনো স্বদেশ কখনো বিদেশ’ বইটি ছাপার সময় আমার প্রকাশক (অনন্যা) বলেছিলেন, আজকাল এরকম মোটা মোটা বই খুব কম পাঠকই পড়েন। তাই আমার মনে হয়, বাঙালি সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে হলে তরুণ সমাজকে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। শুধু ঘটা করে উন্নয়নের বুলি আওড়ালে চলবে না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমাজের বহুবিধ অবক্ষয় কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে সর্বসাধারণের মতো তার কাছে আমারও একটাই দাবি বা প্রত্যাশা, যাকে এক শব্দে বলা যায় সুশাসন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং অতীত সাফল্য দেখিয়েছেন, তা দলমতনির্বিশেষে সবারই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তার দীর্ঘ শাসন আমলে সার্বিক সামাজিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ক্রমাগতভাবে বেড়েছে বলে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেসব ভয়ানক অবক্ষয় একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতি ভয়ানকভাবে শিকড় গেড়েছে, অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে এবং দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইয়াবার মতো মাদকের প্রসার সারা দেশে বেড়েই চলেছে এবং তা সমাজকে গ্রাস করছে। এটিকে কড়াকড়িভাবে নির্মূল করতে হবে। তৃতীয়ত, এটিই শেষ নয়, শহরের রাস্তাঘাট এবং রাজপথে বিশৃঙ্খলা হরহামেশেই লেগে আছে এবং দুর্ঘটনাজনিত কারণে অগণিত মানুষ মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। আমাদের পুলিশ এবং অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কোনো খবরদারি এবং বেপরোয়া গাড়িচালকদের তাৎক্ষণিক বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে, সে রকমটি চোখে পড়ে না। এসব সর্বগ্রাসী এবং পুরোনো ব্যাধিগুলো থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর একদিকে যেমন বায়ুদূষণে পৃথিবীর সব শহরকে টেক্কা দিয়ে শীর্ষে উঠেছে, তেমনই শহরটি নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে হাঁটার জন্য একেবারেই অযোগ্য হয়ে গেছে। আমি উত্তরায় থাকি। এখানে শপিংমলগুলোর আশপাশের বিশ-তিরিশ ফুট রাস্তা দুদিকে তিন সারি করে রিকশা, বেবিট্যাক্সি এবং ফলমূল-সবজি বিক্রেতাদের দখলে থাকায় ফুটপাত উধাও হয়ে গেছে এবং গাড়ি চলাচলের জন্য শুধু দশ-বারো ফুট খোলা থাকে। এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক শহরেই ছুটির একদিন বিভিন্ন এলাকায় কোনো একটি বা একাধিক রাস্তা বা খোলা জায়গা নির্ধারণ করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং রাস্তার পাশের বিক্রেতাদের বেচাবিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হয়। সে ধরনের ব্যবস্থা ঢাকা শহরে চালু করা যায় কি না, আমাদের সিটি করপোরেশন ভেবে দেখতে পারে। বর্তমানে এসব বিক্রেতা রাস্তায় যত্রতত্র সপ্তাহব্যাপী দোকান খুলে মানুষ এবং গাড়িঘোড়া চলাচলের ভীষণ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এতে বসবাসকারীরা স্বচ্ছন্দে চলাফেরার সুযোগের অভাবে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং দোকানপাটে হেঁটে চলে বাজার করতে পারছে না। এটি কোনো সভ্যসমাজেই কাম্য নয়। সৈয়দ নূর হোসেন : সাবেক রাষ্ট্রদূত/সচিব