পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ইফতির স্বপ্ন ছিল গুগলে চাকরির
অনলাইন নিউজ ডেক্স

স্বপ্ন ছিল বড় প্রকৌশলী হবেন। তাই পড়াশোনায় আন্তরিক ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম ইফতি। সর্বশেষ পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন। তাঁকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্নও ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেছে।সন্তানের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে কোনোভাবেই থামছে না মায়ের কান্না। ঘুমের ওষুধেও কাজ হচ্ছে না।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খানাখন্দে ভরা সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন ইফতি। তাই তাঁর অকালে ঝরে যাওয়ার জন্য বাকৃবি প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করছেন নিহতের পরিবার ও সহপাঠীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে গতকাল বুধবার স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁর সহপাঠীরা।সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাকৃবির টিএসসির সামনের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কবলে পড়েন ইফতি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মোটরসাইকেলে করে আব্দুল জব্বার মোড় যাওয়ার সময় ইফতি ও তাঁর বন্ধু রাস্তার গর্তে পড়ে যান। পরে হাসপাতালে মারা যান ইফতি। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রথম ও দিনাজপুরে নিজ বাড়িতে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ইফতির লাশ দাফন করা হয়। পরিবারের সঙ্গে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী ওয়াপদার মোড় এলাকায় বসবাস করতেন ইফতি। তাঁর বাবা রিয়াজুল ইসলাম ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন ইফতি।বুধবার দুপুরে রিয়াজুল বলেন, \'ইফতির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই তার মায়ের কান্না থামছেই না। আমার সব আশা-ভরসা ছিল ইফতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতির কারণেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। যে সড়কে তাঁর মৃত্যু হয়েছে সেখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে গর্ত, কোনো সিগন্যাল নেই, বাঁশ নেই।\' তিনি দুর্ঘটনাস্থলে ছেলের নামে একটি স্তম্ভ চান।দশ দফা দাবিতে আলটিমেটাম : গতকাল ইফতির সহপাঠীরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১০ দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। দাবির মধ্যে রয়েছে নিহতের পরিবারের ক্ষতিপূরণ, প্রক্টরের পদত্যাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং ইফতির স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন।শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ইফতির দুর্ঘটনায় পড়া সড়কটির কিছু অংশ ভেঙে সম্প্রতি মেরামতের কাজ শুরু হয়। কংক্রিটের সড়কটি গর্ত করে রাখা হলেও দুই পাশে কোনো ধরনের সতর্কবার্তা, রোড ডিভাইডার বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল না। হাসপাতালে নেওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঠিক তদারকির অভাবে দায়সারাভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। ইফতি মারা যাওয়ার পর লাশ আনতে প্রক্টরের সাহায্য চাইলে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক লুৎফুল হাসান বলেন, সংস্কারের স্থানটিতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাটি (ব্যারিকেড) আরও জোরালো হতে পারত। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারেননি মা : ইফতির মা মুশফেকা বেবি ছেলেকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মঙ্গলবার রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। এরপরও সারারাতে তিনি ঘুমাননি, কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছেন।গতকাল বিকেলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন তিনি। একটু পরপরই বলে উঠছিলেন, \'আমার বাবা কই গেল?\' তিনি বলছিলেন, \'আমার ছেলেটা দিনরাত পড়ত। মাঝেমধ্যে একটু টিউশনি করত। আমি তাকে বাধা দিলে সে বলত আমার বাবা এতগুলো টাকা কোথায় পাবে মা? তার কোনো বাড়তি চাহিদা ছিল না। তার খুব ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বিদেশে যাবে। সেখান থেকে চাকরি করার পাশাপাশি আরও ডিগ্রি নেবে। তার আগেই সে চলে গেল।\'ইফতির বাবা রিয়াজুল বলেন, \'ঘটনার দিন বিকেলে আমি বরই আর আপেল নিয়ে আসি। অল্প একটু খেয়ে বলে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট হইছে। আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। রাত ১০টার দিকে ওর বন্ধু আমাকে ফোন করে বলে ইফতি এক্সিডেন্ট করেছে। পরে হাসপাতালে যাই। অল্প একটু কথা হয়। আমাকে বলল আমার বুকে, পেটে, ঊরুতে ব্যথা করছে। আর ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় বলল, আম্মু আমি মনে হয় আর বাঁচব না। এরপরই সব শেষ।\' রিয়াজুল বলেন, ইফতি লেখাপড়ায় ভালো ছিল। এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন পেয়েছিল।ইফতির বাড়ি দিনাজপুরের সদর উপজেলার ১০নং কমলপুর ইউনিয়নের রাইহাই পশ্চিম পাড়ায়। নিহতের চাচাতো বোন পারুল বলেন, \'ছোট থেকেই অনেক শান্ত স্বভাবের ছিল ইফতি। আমাদের এখানে এলে কারও সঙ্গে উচ্চঃস্বরে কথা বলত না। সবাইকে সম্মান করত। কোনো বিলাসিতাও ছিল না। সর্বশেষ গত ২৫ ডিসেম্বর এখানে দাওয়াত খেতে এসেছিল। হঠাৎ করে ভাইটা এভাবে চলে গেল!\'
