প্রতিবন্ধীদের আশার আলো সফটওয়্যার
অনলাইন নিউজ ডেক্স

প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষার বিষয়ে দেশে অনেক নীতি রয়েছে, তবে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এ ক্ষেত্রে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনেও বলা আছে, তাদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে উপযোগী করতে হবে। এ লক্ষ্যে ডিজিটাল সেবা প্রতিবন্ধী শিশুসহ এ ধরনের ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যার মধ্যে বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রিকগনিশন (এসএলআর) পদ্ধতি, সাড়ে ১২ লাখ পৃষ্ঠার ব্রেইল বই প্রকাশ, ইশারা ভাষা চ্যাট কমিউনিকেটর, বাংলা \'টেক্সট টু সাইন পাপেট\' (সবার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম), ৫ লাখ বাক্যের ভিডিও ডাটা সেট, বাংলা ব্রেইল কনভার্টার সিস্টেম উল্লেখ্যযোগ্য।
প্রকল্পের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, পৃথিবীর প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আমরা বাংলা ভাষার নেতৃত্ব দিচ্ছি। তাই আমরা বাংলা ভাষাভাষীর উপযোগী সফটওয়্যার তৈরি করছি। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, মুখভঙ্গি বা জেসচারকে ইউনিকোড টেক্সটে রূপান্তর এবং তা থেকে অটোমেটিক স্পিচ জেনারেট করা। এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মোবাইল ফোনের ক্যামেরার সামনে বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রদর্শন করবে। সাধারণত একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দৈনন্দিন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যত পরিস্থিতি তৈরি হয়, প্রায় সবই এর আওতাভুক্ত থাকবে।২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রতিবন্ধীদের ইশারা ভাষা সংক্রান্ত টুল প্রণয়ন ও উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৪৩ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৯ টাকা। চলতি বছরের জুলাইয়ে এ কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা। সার্বিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে ইশারা ভাষা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেন্টার ফর ডিজ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) প্রণীত বাংলা ইশারা ভাষা ও বিধান অনুসরণ করে মান চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ৫ লাখ বাক্যের ডাটা সেট তৈরির কাজ চলছে। এটি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গবেষণা কাজে ব্যবহূত হবে। বিশ্বের যে কেউ তা ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ১২ লাখ পৃষ্ঠার ১০০টি ব্রেইল বই প্রকাশ করা হবে। যার ৫০টি চলতি মাসেই প্রকাশ করার কথা। ব্রেইল বইয়ে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের গল্প-উপন্যাস, ছোটদের শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে। ক্রাউডসোর্স অ্যানোটেশন অ্যাপ্লিকেশনও তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা তাঁদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারবেন।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তির কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। ইতোমধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর ২৪ লাখেরও বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে তাঁদের নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১১ রকম প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিত্বের সন্মুখীন হয়েছেন- এমন ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে বড় অংশ বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের মোট প্রতিবন্ধীর মধ্যে ২২ শতাংশ শ্রবণ ও বাক এবং ২০ শতাংশ দৃষ্টিবিষয়ক প্রতিবন্ধিত্বকে ধারণ করেছেন। অপর একটি সূত্রমতে, বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। যদিও দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার। যার মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার বাক ও ৪৭ হাজার শ্রবণপ্রতিবন্ধী। এ জন্যই প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মপরিসর এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সফটওয়্যার নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। \'গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ\' প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই সফটওয়্যার তৈরির কার্যক্রম চলছে। এর আওতায় ইশারা ভাষা ডিজিটাইজেশন, ব্রেইল সফটওয়্যার তৈরি ও বই ছাপার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো দেশে ইশারা ভাষাকে ডিজিটাইজ করা, যার মাধ্যমে দেশে প্রচলিত ইশারা ভাষা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য, প্রমিত ও ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে। এ ছাড়া বেশ কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সফটওয়্যারও তৈরি করা হচ্ছে এর আওতায়।সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, অনলাইন সেবা কতটা প্রতবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী, তা যাচাই করতে গঠন করা হয়েছে \'অ্যাকসেসিবিলিটি অডিটরস প্যানেল\'। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এই প্যানেলে রয়েছেন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে প্রযুক্তিবান্ধব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইশারা ভাষা ডিজিটাইজেশন প্রকল্পের আওতায় যে অ্যাপ্লিকেশনগুলো তৈরি করা হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষদের প্রাথমিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা দূর হবে। বিশেষ করে এসএলআর ও টিটুএসপি (টেক্সট-টু-স্পিচ)- এ দুটি রূপান্তর সিস্টেমের মাধ্যমে মূক ও বধির ব্যক্তিরা দৈনন্দিন আলাপচারিতা এবং যে কোনো সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যের সঙ্গে বিনা বাধায় যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবেন। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই ইশারা ভাষা রূপান্তর পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবেন। শুধু তাই নয়; সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলোতেও তাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। বাংলা চ্যাট কমিউনিকেটরের মাধ্যমে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং একে অপরের সঙ্গে ছবি, অডিও এবং ভিডিও শেয়ার করতে পারবেন।প্রকল্প পরিচালক মাহবুব করিম বলেন, বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষায় সফটওয়্যার ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হওয়া মানুষ আর সবার মতোই প্রাথমিক শিক্ষা উচ্চশিক্ষা ও দৈনন্দিন প্রয়োজন থেকে পেশাগত জীবনে উৎকর্ষ লাভ করছেন। বাংলাদেশ সেখানে অনেকটা পিছিয়ে। এ জন্য সরকার প্রতিবন্ধীদের উপযোগী প্রযুক্তিবান্ধব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিবন্ধিত্বকে জয় করার পথ সুগম হবে।বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রিকগনিশন সিস্টেম অ্যাপ্লিকেশনটি ইশারা ভাষাভাষীর হাত, আঙুল, মুখ ও অন্যান্য সংশ্নিষ্ট অংশ শনাক্ত করে তা প্রচলিত বাংলায় রূপান্তর করবে। অর্থাৎ কোনো একজন ইশারা ভাষার বক্তা কী বলছেন, তা প্রচলিত বাংলায় রূপান্তর করে দেখাবে এই সিস্টেমটি। ইশারা ভাষা ব্যবহারকারীর জন্য এই সফটওয়্যারটি বিপ্লব বয়ে আনবে। তাঁদের জন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্র যেমন- চিকিৎসার সময় ডাক্তার ও পুলিশের সঙ্গে ঘটনা বর্ণনায় বা কথোপকথনে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা আর থাকবে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতিবন্ধীরা নানাভাবে সামাজিক সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা গেলে অনেক সংকটই কেটে যাবে। প্রতিবন্ধীরা ইতোমধ্যে ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এটি আশাব্যঞ্জক। সরকারকে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নয়তো সবল বরাবর সবল থেকে যাবে; দুর্বল আরও দুর্বল হবে।
