বাংলা ভাষা ব্যবহারে সংকট কোথায়


বাংলা ভাষা ব্যবহারে সংকট কোথায়
গত দুই দশকে নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে বাংলা ভাষা। নতুন প্রজন্মসহ দেশের প্রায় সব বয়সী মানুষই কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইংরেজির চেয়েও বাংলা অনেক বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারে এখন তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বশিক্ষিত মানুষও এখন ব্যবহার করছে এ সামাজিক যোগাযোগ। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা কতটা ব্যবহার উপযোগী হয়েছে।খোদ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এক প্রতিবেদন বলছে, দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভিত্তি দেশে এখনও তৈরি হয়নি। বিশেষ করে কম্পিউটিংয়ে বাংলা ভাষাকে অভিযোজিত করার ক্ষেত্র তৈরিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তবে সরকার বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর কথা চিন্তা করে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অভিযোজিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতৃস্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য।ভাষা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইথনোলগের ২০২০ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০০টি বহুল ব্যবহূত ভাষার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বভাষা তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম। তবে বহুল ব্যবহূত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন। তবে মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান তৃতীয়। দেশীয় গবেষকরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে সাবলীল হওয়ায় ব্যবহারে ইংরেজির অবস্থান শীর্ষে। বাংলা ভাষা তুলনামূলক বিচারে পিছিয়ে। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সরকার প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৬টি টুল উন্নয়নের কথা রয়েছে, এটি কার্যকর হলে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে মানুষের ধারণা বদলে যাবে। তিনি জানান, এ টুলগুলো ডেভেলপ হলে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ফন্ট বিশ্বজনীন ব্যবহার উপযোগী হবে। এটি হলে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি পেতে সরকার চেষ্টা চালাবে।বাংলা ভাষার বিকাশ : বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরের পুরোনো। চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এখন প্রায় ৩৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষী রয়েছেন। কিন্তু ইংরেজির আগ্রাসন বাংলাকে সংকুচিত করছে। মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই প্রতিটি দেশ নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে আসছে, ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। তবে নানামুখী তৎপরতা সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে দেশে আইন থাকলেও তা উপেক্ষিত। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি প্রাধান্য পাচ্ছে।বাংলা ভাষা ব্যবহারে উদাসীনতা কেন- এ প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঔপনিবেশিক মানসিকতার জন্য ইংরেজির ব্যবহার হচ্ছে। আর তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ব্যবহারের জন্য কারিগরি সমস্যা দায়ী। সাধারণ মানুষ যিনি বাংলা-ইংরেজি দুই-ই জানেন, তিনিও ইংরেজিতে লিখে থাকেন। এর জন্য দায়ী বাংলার নানা ফন্ট। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি ফন্ট হওয়া উচিত। এ জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। তারা বিদ্যমান ফন্টগুলো পর্যালোচনা করে ঠিক করবে কোনটি সুবিধাজনক, সেটাই ব্যবহারের জন্য স্বীকৃতি পাবে। এই ফন্ট আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে করতে হবে। যাতে বিশ্বজনীন হয়। তাঁর মতে, বর্তমানে একেকজন একেক ফন্ট ব্যবহার করায় ফন্টগুলো ভেঙে যায়, অনেক মাধ্যমে তা দেখাও যায় না। এই সংকট বাংলা ভাষা ব্যবহারে অন্যতম প্রধান অন্তরায়।বাংলা ফন্টের আদ্যোপান্ত : ফন্ট হলো এক প্রকার লিপি। ১৯৫০-এর দশকে বাংলা ফন্টের আবির্ভাব হয় \'কবর\' এবং \'রক্তাক্ত প্রান্তর\' নাটকের রচয়িতা ভাষাবিজ্ঞানী মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে। তিনি উদ্ভাবন করেন প্রথম বাংলা টাইপরাইটার লেআউট \'মুনীর অপটিমা\'। তবে এটি তেমন কার্যকরী ছিল না। তখনও বাংলা ভাষা টাইপিংয়ে রোমান হরফ মুক্ত হয়নি। এই সংকট থেকে ১৯৬৫ সালে আবারও মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে আসে প্রথম বাংলা টাইপরাইটার লেআউট। বাংলা ভাষার জন্য এটি অভাবনীয় বিপ্লব। তবে এরও ছিল অনেক সীমাবদ্ধতা। আশির দশকে জাপানের এক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রকৌশলী সাইফ শহীদ শুরু করেন বাংলা লেআউটের কাজ। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনটি ফন্টে প্রকাশিত হয় কম্পিউটারে লেখার উপযোগী প্রথম বাংলা লেআউট \'শহীদলিপি\'। অবশ্য শহীদলিপি দিয়ে বাংলা লেখা সহজ ছিল না। এ লক্ষ্যে ১৯৯০ দশকে তৎকালীন সাংবাদিক ও পরে ব্যবসায়ী মোস্তাফা জব্বার (বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী) উদ্ভাবন করেন সম্পূর্ণ নতুন একটি লেআউটসহ বাংলা লেখার সফটওয়্যার \'বিজয়\'। বর্তমানে বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের বিজয় একাত্তর সংস্করণে ১০৮টি বাংলা ফন্ট রয়েছে। এটি বিশ্বের বাংলা সফটওয়্যারে অনন্য রেকর্ড। দীর্ঘদিন ধরে বিজয় ফন্ট গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন অফিসে ব্যবহূত হচ্ছে। তবে বর্তমান ইন্টারনেট জগতে সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে প্রথম বাংলা ফোনেটিক লেআউট ফন্ট \'অভ্র\'। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তরুণ ছাত্র মেহেদী হাসান খান \'ভাষা হোক উন্মুক্ত\' স্লোগানে ৬ বন্ধুর সহায়তায় এটি প্রকাশ করেন। বাংলা ফন্টের নিজস্ব ঐতিহ্য থাকলেও তা সবই হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে।যেভাবে সমাধান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আমরা অনেক পিছিয়ে। মুখে বললে ইংরেজিতে অ্যাপের মাধ্যমে লেখা হয়ে যায়, অথচ বাংলায় আমরা এমন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। এ জন্য প্রয়োজন বাংলা ভাষার করপাস (শব্দভান্ডার)। যার আওতায় বাংলা ভাষার যত ধরনের শব্দ, বানান, বাক্য থাকতে পারে, তা লিপিবদ্ধ থাকবে।বাংলা ভাষার করপাস তৈরির জন্য ২০২০ সালে একটি উদ্যোগ নেয় সরকার, যা এখনও চলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রযুক্তির সমস্যা সমাধান করতে হলে ভাষাবিজ্ঞানী এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভাষাবিজ্ঞানী ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, দুঃখজনক হলো তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবে বাংলা ভাষা তার সঙ্গে এখনও সম্পৃক্ত হতে পারেনি। বাংলা ভাষার যে লেখ্যরূপ, তার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো প্রয়োজন। বিশেষ করে যুক্ত ব্যঞ্জনগুলো প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ কারণেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা বাংলা ভাষাকে কঠিন বলে মনে করেন। এভাবে চলতে দিলে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের আরও অনীহা তৈরি হবে। বানানের ভুল সংশোধন ও চৌর্যবৃত্তি রোধের জন্য সফটওয়্যার তৈরির ওপরও জোর দেন তিনি। তবে তথ্যপ্রযুক্তির চেয়েও বাংলা ভাষার সঠিক উচ্চরণ ও ব্যাকরণ জানা এবং তার প্রয়োগিক চর্চা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় বাক্যবিন্যাস এবং ব্যাকরণে আমাদের দুর্বলতা ব্যাপক। বাংলা ভাষা হলো যেভাবে উচ্চরণ করব ঠিক সেভাবেই বলতে হবে, লিখতে হবে। এ জন্য আমাদের যথার্থ শিক্ষক প্রয়োজন। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করবেন।বিশিষ্ট এই অধ্যাপকের মতে, ব্যবস্থাপনায় গলদ রেখে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আশা করা অবাস্তব চিন্তা। সরকারকে আগে ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে।