বিস্ফোরণে এবার কাঁপল সায়েন্স ল্যাব মোড়


বিস্ফোরণে এবার কাঁপল সায়েন্স ল্যাব মোড়
ষাট পেরোনো আবদুর রাজ্জাক। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট এলাকাটি তাঁর চেনা– তাও ৪০ বছর। বিভিন্ন সময় এ দুই এলাকার বিভিন্ন দোকানে কাজ করেছেন কর্মচারী হিসেবে। এখন সায়েন্স ল্যাব এলাকার শিরিন ম্যানসনের মেহেদি পাঞ্জাবী হাউজে বিকিকিনিতে ব্যস্ত থাকেন। নিত্যদিনের মতো গতকাল রোববার সকাল পৌনে ১১টার দিকে দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রাজ্জাক। হঠাৎ বিকট শব্দ! কেঁপে উঠল সায়েন্স ল্যাবের আশপাশ। মুহূর্তেই ওই ভবনে ধরে যায় আগুন।ভবনের ওপর থেকে পড়তে থাকে ইট-সিমেন্টের টুকরো অংশ। চারদিকে ধোঁয়া। ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে অনেকে উড়ে এসে রাস্তায় আছড়ে পড়ছিলেন। চোখের সামনে এমন বিভীষিকা দেখে দৌড়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচান রাজ্জাক। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে (মিরপুর রোড) সুকন্যা টাওয়ারের কাছে তিনতলা শিরিন ম্যানসনে হঠাৎ বিস্ফোরণের এমন মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্লান্টে রক্তাক্ত বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ঘটল আরেকটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিনজন। আহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ অর্ধশতাধিক। তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত তিনজন হলেন আবদুল মান্নান (৬২), শফিকুজ্জামান শফিক (৪৭) ও সাদিকুর রহমান তুষার (৩৫)। মান্নানের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কোনাপাড়া; শফিকের রাজবাড়ী ও তুষারের নরসিংদীতে। তিনজনই বিধ্বস্ত ভবনটির তৃতীয় তলায় নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। বিস্ফোরণের পর তৃতীয় তলা থেকে তাঁরা ছিটকে পড়ে মারা যান। আগুনে তাঁদের শরীরের কিছু অংশ পুড়েও যায়। রাতে তিনজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়।ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটনাস্থলে বারুদ বা ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। পুলিশের ভাষ্য, নাশকতার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এটি দুর্ঘটনা। বিধ্বস্ত ওই ভবনে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি মিলেছে। এই গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে।ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাকে প্রাথমিকভবে ‘দুর্ঘটনা’ বলে মনে করছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রোববার দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে, এটি দুর্ঘটনা। বোমা ডিসপোজাল টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে অন্য কোনো কারণে হয়েছে কিনা, তা খুঁজে দেখতে আরও তদন্ত প্রয়োজন। ঘটনাস্থলে বোমাসদৃশ বা স্প্লিন্টার জাতীয় কোনো কিছু পাওয়া যায়নি।’এদিকে দুর্ঘটনার পর সকাল ১১টা থেকে মিরপুর রোডের ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাবসহ আশপাশ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। ৫ ঘণ্টা পর বিকেল ৪টা থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে।বিধ্বস্ত পুরো এলাকা : সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে ১০০ গজের মতো নিউমার্কেটের দিকে এগোলে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উল্টো পাশে তিনতলা ওই ভবন। এক পাশে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, আরেক পাশে কাদের আর্কেড নামের ভবন। পেছনে সুরাইয়াস ড্রিম, সুকন্যা টাওয়ারসহ দুটি বহুতল আবাসিক ভবন। বিস্ফোরণের পর বিধ্বস্ত ভবনটি একদিকে হেলে পড়েছে। ভবনজুড়ে দেখা দিয়েছে ফাটল। আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ইটপাথর, অফিসের চেয়ার-টেবিল, দরজার শাটার, ভাঙা টুকরো কাচসহ নানা আসবাব। বিধ্বস্ত ভবনের সামনের সড়কের বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে রক্তচিহ্ন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রশি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করেছে। তিনতলা ভবনের নিচতলায় রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট, পাঞ্জাবির দোকানসহ ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; দোতলায় একটি সেলুনসহ ৫টি প্রতিষ্ঠান; তৃতীয় তলায় নিউ জেনারেশন কোম্পানি ও ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বিস্ফোরণের পর ওই ভবনের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কোনো কোনো দোকানের সিলিং ফ্যান ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) খুলে রাস্তায় এসে পড়ে। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল; ঘটনাস্থল থেকে ৫০০-৬০০ মিটার দূরেও বিভিন্ন ভবনের কাচ ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।‘দ্বিতীয় জীবন পেলাম’: বিধ্বস্ত ওই ভবন ও আশপাশ থেকেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন এমন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। ভবনটির নিচতলায় রয়েছে ‘ক্যাফে ধানমন্ডি’ নামে একটি রেস্তোরাঁ। সেখানকার কর্মচারী ওমর ফারুক বলেন, ১৫ থেকে ২০ জন বসে রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতা করছিলেন। হঠাৎ বোমা ফাটার মতো বিকট শব্দ পাই। এর পর ৭-৮ সেকেন্ডের মধ্যে ইট–পাথর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। দোকানের পেছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে সবাই বাইরে চলে আসি। এর পর দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন ভবনের আশপাশে পড়ে আছেন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কেউ আবার সেলফি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। পাশের ভবনের দোকান কর্মচারী মো. হোসাইন বলেন, সবে দোকানের শাটার খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ আশপাশ এলাকা কেঁপে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোকানের কাচ ভেঙে মেঝেয় পড়তে থাকে। ওই এলাকার একাধিক দোকান কর্মচারীর ভাষ্য, বিধ্বস্ত ওই ভবনটির মালিক শিরিন শারমিন নামে ইংল্যান্ড প্রবাসী নারী। তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম ভবনটি দেখাশোনা করেন। ওই ভবনের সামনে চায়ের দোকান রয়েছে কালামের। বাস করেন ভবনটির দোতলায়। ভবনের সিকিউরিটি গার্ড আবদুল কাদির বলেন, বিস্ফোরণে সময় ভবনের গেটে বসে ছিলাম। কাঁপন এতটা ভীতিকর ছিল; হঠাৎ চেয়ার থেকে পড়ে যাই। মনে হলো, ভূমিকম্প হচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরই ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে নিচে নামতে থাকেন।মো. শফিক নামে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের দোকানি বলেন, বিস্ফোরণের সময় ফুটপাতে দোকানে বসার সময় হয়নি। যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটির সামনের ফুটপাতে অন্তত ২০টি দোকান বসে। দুপুর ১২টা থেকে এসব দোকান খুলতে শুরু করে। ঘটনাটি ১১টার দিকে হওয়ায় বড় ধরনের প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। বিধ্বস্ত ভবনটির পাশে আরেকটি ভবনে কোচিং সেন্টার রয়েছে। সেখানকার দু’জন আহত হয়েছেন।বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শন: ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেনাবাহিনীর সিডিআরটি ও বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের দুটি দল। এ ছাড়া পুলিশের বোমা ও সিবিআরএন টিমও সেখানে যায়। পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ও সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর মনে করছি, কোনো বিস্ফোরক দ্রব্যের মাধ্যমে এটি হয়নি। যদি বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা হতো, তাহলে যন্ত্রের মাধ্যমে সেটা বুঝতে পারতাম। এটি যে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে প্রকৃত কারণ জানার জন্য আরও তদন্ত করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা বলতে পারি, এখানে বারুদ বা আইইডি ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’ঘটনাস্থলে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনাস্থলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। স্যুয়ারেজ লাইন বা তিতাসের লাইন থেকে মিথেন গ্যাস সেখানে জমতে পারে। সাধারণত কোনো আবদ্ধ স্থানে স্বাভাবিক ঘনত্বের চেয়ে গ্যাসের অবস্থান বেশি থাকলে তা বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্ট সার্কিট ও দেশলাই বা অন্য কোনো সূত্র থেকে আগুনের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। প্রাথমিক ধারণা, তৃতীয় তলার ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের কার্যালয় থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। গ্যাসের অরক্ষিত পাইপলাইন বা স্যুয়ারেজ লাইন থেকেও গ্যাস জমতে পারে। গ্যাসের কারণেই বিস্ফোরণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে মগবাজারের বিস্ফোরণের মিল রয়েছে।ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তাঁদের মনে হয়েছিল, এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। তদন্ত শেষে আসল কারণ বেরিয়ে আসবে।হাসপাতালে আহাজারি: বিস্ফোরণের পর আহত ৩০ থেকে ৪০ জনকে তাৎক্ষণিক নেওয়া হয় কাছের পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সেখানে আবদুল মান্নান, শফিকুজ্জামান শফিক ও সাদিকুর রহমান তুষারকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহত ও আহতদের স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। একই দৃশ্য ছিল ঢামেকেও। সেখানেও নেওয়া হয়েছে ২২ জনকে। ভবনটির তিনতলায় ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের কার্যালয়ে ছয়জন কাজ করছিলেন। তাঁরা সবাই আহত হয়েছেন। এর মধ্যে অফিস ইনচার্জ সৈয়দ আকবর আলী, সৈয়দ আশরাফুজ্জামান, আয়েশা আক্তার আশা, স্বপ্না ও জহুর আলীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। আশার শরীরের ৩৮ শতাংশ, জহুরের ৪৪, আকবরের ৩৭ ও আশরাফুজ্জামানের শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢামেকে চিকিৎসাধীন আরও যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন– তাজুদ্দিন, মেহেদি হাসান, জাকির হোসেন জুয়েল, কামাল, রাবেয়া খাতুন ও তামান্না।অল্পের জন্য বাঁচলেন ঢাবি ছাত্র: বিস্ফোরণের সময় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. নুরন্নবী। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক এ শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর সহপাঠী জানান, বিস্ফোরণের সময় তিনি ভবনের নিচে ছিলেন। তিনতলা থেকে ভারী কিছু একটা পড়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পাশাপাশি তাঁর ডান পা ভেঙে গেছে।