মন্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না বিএনপি


মন্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না বিএনপি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে চলছে বেশ নাটকীয়তা। বিষয়টি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন খোদ সরকারের দায়িত্বশীল সিনিয়র মন্ত্রীরা। ইতোপূর্বে দু\'জন মন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই। তবে দণ্ডিত হওয়ায় তিনি নির্বাচনে অযোগ্য। আবার গতকাল বৃহস্পতিবার আরও দু\'জন সিনিয়র মন্ত্রী বললেন, শর্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার সুযোগ নেই। সিনিয়র মন্ত্রীদের বিপরীতমুখী এমন বক্তব্যে বিস্মিত রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও আইনজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মন্ত্রীদের বক্তব্যের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। তবে বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তাঁরা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টিকে \'নতুন ষড়যন্ত্র\' বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। গতকাল রাতে আবার দলটির নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়া কারও অনুমোদন কিংবা করুণা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। তিনি সুস্থ থাকলে জনগণ ও সময়ের তাগিদেই রাজনীতি করবেন।খালেদা জিয়ার ইস্যুটি নিয়ে গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কথা বলেন। এটি প্রথম সামনে আনেন আইনমন্ত্রী এবং পরে কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এই দুই মন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত হয়। অনেকে মনে করেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলার নেপথ্যে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংলাপে বসার \'ইঙ্গিত\'। আবার কেউ বলছেন, সরকার বিদেশিদের চাপের মুখে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রমাণ করতেই খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই বলছে। প্রকৃতপক্ষে অসুস্থ খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে মানবিক আবেদনে সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁর সাজা স্থগিত করেছে। রাজনীতিতে সক্রিয় হলেই তাঁর সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করে দিতে পারে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রাতে বলেন, প্রথম থেকেই এটিকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। তাঁদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন হিসেবেই মনে করেছি। দলের সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আসল কথা বেরিয়ে এসেছে। আসলে তাঁরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করার সুযোগ দিতে চান না। তাছাড়া এখন তিনি অসুস্থ। সুস্থ হলে এবং সময় হলে খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন। এটা কারও বক্তব্যের ওপর নির্ভর করবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের নিচ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত সবার বক্তব্যই এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। জনগণ এই সরকারের কোনো মন্ত্রীকে বিশ্বাস করে না।আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, দণ্ডিত হিসেবে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার সুযোগ নেই। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের এক যৌথ সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়াকে দ দিয়েছেন আদালত। দ থেকে মুক্তি পাননি তিনি। সরকার মানবিক কারণে তাঁকে বাসায় থাকার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে তাঁর রাজনীতি করার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়াকে তাঁর শারীরিক অবস্থা এবং বয়স বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শর্তের কারণেই তিনি রাজনীতি করতে পারেন না। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, শর্তের মধ্যে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন, এমনটি নেই। শর্তে বলা হয়েছে, তিনি ঘরে থেকে চিকিৎসা নেবেন। অন্য কোনো কর্মকাে অংশগ্রহণ করবেন না, সেটি বলা আছে। সুতরাং, তাঁর রাজনীতি করতে পারারও কথা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে খোঁজ-খবর নিয়েছি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কেউ যদি দুই বছরের বেশি শাস্তি পান, তিনি নির্বাচনে অযোগ্য। খালেদা জিয়ার দণ্ড দুই বছরের অনেক বেশি। সুতরাং, তাঁর তো নির্বাচন করার প্রশ্নই আসে না।একই দিনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনীতি করার বিষয়ে কোনো আইনি বাধা নেই। তবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) রাজনীতি করতে পারবেন না, এ রকম কথা তো কোথাও নেই। আইনিভাবে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন। তাঁর দণ্ডাদেশ স্থগিত হয়েছে অসুস্থতার কারণে, এটি মনে রাখতে হবে। এখন বাস্তব অবস্থা কী, সেটাও আপনারা জানেন।আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করেন, তাঁর (খালেদা জিয়ার) ভাই যে আবেদন করেছেন, সে আবেদনের মধ্যে বলা আছে, তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাঁর যদি আরও ভালো চিকিৎসা না হয়, জীবন বিপন্ন। মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী সাজা স্থগিত রেখে তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন। যিনি অসুস্থ তিনি রাজনীতি করতে পারবেন কিনা- সে বিষয়ে আমি বারবার বলেছি। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ মনে করে, খালেদা জিয়া অসুস্থ, রাজনীতি করতে পারবেন না। এটিই বাস্তব অবস্থা।খালেদা জিয়া তাঁর দলীয় কার্যালয়ে অফিস করতে পারবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, আমি সব পরিস্কার করেছি। এখন ওনাদের যদি এ বিষয়ে আরও জানার দরকার হয়, আইজীবীর কাছে চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করুক। তাঁরা যদি ব্যর্থ হলে আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে বলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, দু\'বারের প্রধানমন্ত্রী, কেন তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না? রাজনীতিবিদ তো রাজনীতিবিদই, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ, তাই খালেদা জিয়া জেলে থাকলেও রাজনীতি করতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। উনার রাজনীতির ক্ষেত্রে বাধা নেই।সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না গতকাল রাতেবলেন, যারা ক্ষমতায় থাকে, আইন তাদের পক্ষে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীনরা মনের মাধুর্য মিশিয়ে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এটা আমরা অতীতেও দেখেছি এবং বর্তমানেও দেখছি। যে কারণে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যা দিবসকে ক্ষমতাসীনরা ভালোবাসা দিবসে পরিণত করেছিল। মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁদের বক্তব্য আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আছে। কারণ পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও তাঁরা হজম করছেন। এটাও এক ধরনের গণতান্ত্রিক সহনশীলতা।বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গতকাল রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো ভিডিও বার্তায় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তা নতুন নয়। তারা নিজেরাই ইস্যু তৈরি করে, আবার নিজেরাই বাষ্পের মতো উড়িয়ে দেয়। পুডিংয়ের মতো বানিয়ে নিজেরাই আবার কেটে খায়। এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাই না। খালেদা জিয়া জনগণের নেত্রী- কারও অনুমোদন, করুণা, সদিচ্ছা এবং ইঙ্গিতের অপেক্ষায় তিনি রাজনীতিতে আসেননি। ভবিষ্যতেও আসবেন না। আর যখন রাজনীতি করার প্রয়োজন হবে, জনগণের পাশে থাকার তাগিদে তিনি নিজেই তা করবেন। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। দুটি মামলায় দ প্রাপ্ত সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি ছিলেন। বর্তমানে নির্বাহী আদেশে দ স্থগিত হওয়ায় তিনি নিজ বাসায় অবস্থান করছেন।দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তির পর থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের ভাড়া বাড়িতেই অবস্থান করছেন। ওই সময় সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রথমে ছয় মাসের জন্য শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। \'দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর\'-এর ধারা-৪০১ (১)-এ দেওয়া ক্ষমতা বলে খালেদা জিয়ার দ াদেশ স্থগিত করা হয়। এর পর প্রতি ছয় মাস পরপর তাঁর সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এবার নিয়ে ছয়বার তাঁর সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ছে।