আসুন শিখে শিক্ষিত হই


এখনও শিক্ষা বলতে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদভিত্তিক শিক্ষাকেই বুঝতে এবং বোঝাতে চাই। একজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় এক দশক পড়ালেখা করতে হয় ‘কী শিক্ষা, কেন শিক্ষা’ প্রশিক্ষণ নিতে। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত শিক্ষক হিসেবে দক্ষ করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর শিক্ষার্থীর শেখা ও শিক্ষিত হওয়া নির্ভর করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সনদের মাধ্যমে তাঁর যোগ্যতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু তিনি প্রকৃত শিক্ষায় কতটা শিক্ষিত হয়েছেন, সনদ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে কি? মূলত প্রকৃত শিক্ষা ও সনদভিত্তিক শিক্ষা– দুটোই আমাদের প্রয়োজন। আমরা শিখতে চাই কিন্তু শিক্ষিত হতে চাই না। যার ফলে সৃজনশীল, সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত হতে পারছি না। কারণ কী? আমরা জন্মের শুরু থেকেই শিখছি। শিখতে শিখতে মস্ত বড় ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ফাঁকিবাজ হয়ে জীবন যাপন করছি। প্রশ্ন, আমরা তাহলে কী শিখছি? একটি দেশের পাঠ্যপুস্তকের গঠন, প্রশিক্ষণের ধরন, শিক্ষকের গুণগত মান এবং যোগ্যতা যদি লক্ষ্য করি, তবে জানা ও বোঝা যাবে– কী শিক্ষা সেখানে হচ্ছে। জাতি হিসেবে তাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের পরিধিই বা কোন স্তরে! তার আগে আসুন একজন সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোকের সম্পর্কে জানি। একজন শিক্ষিত লোক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী যা শেখার সেগুলো শিখে মস্ত বড় শিক্ষিত হয়ে সমাজের একটি গুরুদায়িত্বের কাজ শুরু করলেন। যা শুরু করলেন, সেখানেও কিন্তু সিলেবাস অনুযায়ী কাজ করতে হবে; নইলে সেই গুরুদায়িত্বের শীর্ষে পৌঁছা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে রুটিন অনুসরণ করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করেছেন কি, বেশির ভাগ লোকই তাঁর দায়িত্ব শেষ হলে উপলব্ধি করেন এবং বলেন, জীবনে কোন ভুলগুলো করেছেন বা কী করলে কী হতো-না হতো ইত্যাদি। পরে তাদের বেশির ভাগই জনদরদি হন বা হতে চেষ্টা করেন। কেউ সার্থক হন, কেউ হন না। যারা সার্থক হন তারা জনদরদি হওয়ার আগে বলেছিলেন, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন। কিন্তু কর্মের মেয়াদ শেষে দেখা গেল, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি; হয়েছে সেই জনদরদির মাত্র। সমাজের এসব সমস্যা আমরা জানি। কিন্তু কিছু করতে পারছি না। আমি যতটুকু বুঝি, সমস্যার সমাধান করার জন্যই আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে নানা কর্মে জড়িত হই, অথচ সমস্যার সমাধান করতে পারি না। আবার পারলেও দেখা যায় নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। যেমন– এ সময় দেশের জন্য ইউনূস ও বাইডেন ইস্যুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ডেঙ্গু থেকে জনগণকে রক্ষা করা। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে দেশে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আক্রান্ত দুই সহস্রাধিক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ইতোমধ্যে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৮০০ অতিক্রম করেছে, যা ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ মৃত্যুর প্রায় তিন গুণ। ওই বছর ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এদিকে, এ বছর প্রাণঘাতী রোগটা রাজধানীর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি কিছুদিন ধরে ঢাকার চেয়ে জেলা-উপজেলাতেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এ অবস্থা বিগত বছরগুলোতে পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু সে বিষয় নিয়ে কথা নেই। এসবও বলা হচ্ছে, বর্তমান ছাড়া ভবিষ্যৎ অচল। এতক্ষণ যে সমস্যাগুলো বর্ণিত হলো তা নতুন কিছু নয়। এ সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। আমি আজ যে বিষয়টি তুলে ধরব, তাতে নিশ্চিতভাবেই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বর্তমান বিশ্বের শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে, যদি আমরা শিক্ষাকে সর্বাঙ্গীণ সামনের দিকে নিতে চাই। পৃথিবীর লোকসংখ্যার যে শ্রেণিটির বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে, সেই শ্রেণির মানুষের দিকে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, এ সময়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটতে থাকে। এ সময়ে যে রকম বীজ বপন বা রোপণ করা হবে, ফলও সে রকম হবে। এই সময়ে শরীরের বিশাল পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। সময়টি দিকনির্দেশনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। যেমন– কী বা কোন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন হবে, এটি একটি দিক; প্রেম-ভালোবাসার জোয়ার শরীরে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা আরেকটি দিক। যদি শিক্ষায় যৌনতার মতো আনন্দ না লাগে, তাহলে কী হবে? বেশির ভাগই শিক্ষা ছেড়ে অন্য পথ বেছে নেবে। শিক্ষাকে পরিবারের চাপে ধরে রাখবে পুথিগত বিদ্যা হিসেবে। এমন একটি স্তরে দরকার দক্ষ শিক্ষক, দরকার মজবুত পরিকাঠামো, দরকার সৃজনশীল প্রশিক্ষণ। আছে কি বিশ্বের কোনো দেশ, যেখানে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিক্ষা পদ্ধতিকে গড়ে তোলা হয়েছে? পুরোপুরি না থাকলেও কয়েকটি দেশে আছে। তার মধ্যে কানাডা, ফিনল্যান্ডের নাম আসতে পারে। তবে সুইডেনের একজন শিক্ষককে আমি চিনি, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাজটি করে আসছেন তাঁর মূল কর্মের পাশাপাশি। এখন তিনি অবসর সময় পার করবেন আনন্দ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে। তিনি মূলত সময়টি পার করছেন সুইডিশ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। তিনি অষ্টম এবং নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞান কীভাবে শিখতে হয়, তার ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষক মূলত এ কাজগুলো করেন, তাদের মেন্টর হিসেবে তদারকি করছেন। এটি এরই মধ্যে সুইডেনের শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা সাড়া ফেলতে শুরু করেছে। ভদ্রলোক আমার বড় ভাই অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধা। তিনি আজীবন বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেছেন তাঁর শিক্ষাজীবন শেষে। এখন তাঁর অবসরের সময়। জীবনের এ সময় আর ১০ জনের মতো নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলা বা ঘোরাফেরা করে সময় কাটাবেন। অথচ তিনি তা না করে করছেন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা। ইট তৈরি করতে যেমন ডাইস দরকার; ঠিক প্রকৃত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা পেতে দরকার এই ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সের ছেলেমেয়ের মধ্যে শেখার জন্য শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। শিক্ষার মধ্যেও যে চমৎকার মজা রয়েছে, সেটি ধরিয়ে দেওয়া তাদের মনপ্রাণ, চিন্তাভাবনা ও ধ্যানে। তিনি চেষ্টা করছেন মুকুলেই যেন তরুণ প্রজন্ম ঝরে না যায়। তিনি শেখাচ্ছেন কীভাবে শিখতে হয়। যদি ড. মান্নান মৃধার প্রজেক্ট কৃতকার্য হয়, তবে ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষাধারী শিক্ষক খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যেতে হবে প্রাইমারি স্কুল লেভেলে। কারণ শিক্ষার শুরুটা ওখানেই। ফাউন্ডেশন যদি ভালো না হয় তাহলে বিল্ডিং যত তলারই হোক না কেন, তা যেমন ভেঙে পড়বে, ঠিক যত উঁচু দরের শিক্ষিত শিক্ষক পরবর্তী স্টেপে নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, ভালো প্রডাক্ট কখনও পাওয়া সম্ভব হয়নি, হবেও না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জেলহাজত না বানিয়ে বরং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলুন, যেখানে পরস্পর জানবে, শিখবে এবং শেখাবে।