যেভাবে ডাচ্-বাংলার টাকা লুট


যেভাবে ডাচ্-বাংলার টাকা লুট
ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাইকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে আটজনের বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জ। ভাড়াটে ছিনতাইকারী হিসেবে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত টাকা লুটের ওই অপারেশনে ১২-১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। এদের মধ্যে এনামুল হক বাদশা নামে একজন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, চুরি, ছিনতাইয়ের ২৭টি মামলা।গত ৫ বছরের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটায় সে। সুনামগঞ্জের দক্ষিণ আরপি নগরের রিতু মিয়ার ছেলে বাদশা। ছিনতাইকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিল চারজন। তাদের মধ্যে মো. ইমন ওরফে মিলন ও সানোয়ার হাসানকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মিলন একটি স্পা সেন্টারে চাকরি করে। সানোয়ার বেকার। সুনামগঞ্জ থেকে ভাড়াটে লোক এনে ডাকাতির কাজে লাগানোর দায়িত্ব ছিল সানোয়ারের। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।৯ মার্চ তুরাগ থানাধীন দিয়াবাড়ী ১১ নম্বর সড়কে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্লান্ট লিঙ্ক প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়ি থেকে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন সকাল ৬টার দিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের সড়কে একটি মাইক্রোবাসে ওঠে ডাকাত দলের সদস্যরা। সিলেট যাওয়ার কথা বলে আগের দিন মাইক্রোবাসটি ভাড়া করে তারা। ঘটনার দিন সিলেটে রওনা হওয়ার কথা বলে চালককে কুর্মিটোলায় ডেকে আনে। যাত্রী পরিচয়ে ছদ্মবেশী ডাকাতরা মাইক্রোবাসে ওঠার পরই চালক আকাশ মাদবরকে হাত-পা ও মুখ বেঁধে গাড়ির পেছনে ফেলে রাখে। এর পর তারা একটি পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেয়। ওই সময় মাইক্রোবাস চালায় ডাকাত দলের এক সদস্য। ছক মোতাবেক সোয়া ৭টার দিকে তারা টাকাভর্তি মানি প্লান্ট লিঙ্কের গাড়ি লুট করতে দিয়াবাড়ী এলাকায় চলে যায়। কোনো অস্ত্র ব্যবহার ও রক্তপাত ছাড়াই ছিনতাই অপারেশন সফল করে। মানি প্লান্টের গাড়িতে থাকা টাকাভর্তি চারটি ট্রাঙ্ক মাইক্রোবাসে তুলে তারা ৩০০ ফিট এলাকায় চলে আসে। চলন্ত গাড়িতে ডাকাত দলের সদস্যরা ট্রাঙ্ক কাটে। ছিনতাইকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা চালের দুটি বস্তাসহ ছোট-বড় ৫টি ব্যাগ সঙ্গে নিয়েছে। ট্রাঙ্ক থেকে ৫টি বস্তা ও ব্যাগে টাকা ভরে তারা। তবে বস্তা বেশি না থাকায় তারা বাকি ট্রাঙ্ক কাটেনি। এ ছাড়া একসঙ্গে এত টাকা দেখে ডাকাত দলের সদস্যরা ভড়কে যায়।তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৯ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ডাকাত দলের সদস্যরা ৩০০ ফিট এলাকায় ছিল। টাকাভর্তি ৫টি বস্তা নিয়ে তারা মাইক্রোবাস থেকে নেমে সিএনজি, অটোরিকশা ও গাড়ি ভাড়া করে বনানী এলাকায় যায়। যে চারজন মূল পরিকল্পনায় জড়িত ছিল; বনানীতে তারা গেছে বলে এখন পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গেছে। ভাড়াটে ডাকাতদের প্রত্যেককে তাৎক্ষণিক অল্প টাকা দেওয়া হয়। এর পর যার যার মতো তাদের পালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয় পরিকল্পনাকারীরা।আরেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে ডাকাত চক্রের সবাই মাইক্রোবাসের ভেতরে পোশাক বদল করে। লুট করার সময় জড়িত অনেকে পাঞ্জাবি, প্যান্ট পরিহিত ছিল। পালানোর সময় প্রত্যেকে নতুন পোশাক পরে। আলামত লুকাতে গ্লাভসও ব্যবহার করেছে তারা।তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ডাকাত চক্র ৩০০ ফিট এলাকায় মাইক্রোবাস ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পর চালক আকাশ গাড়ির ভেতরে হাত-পা নাড়িয়ে দাপাদাপি শুরু করে। পথচারীরা বিষয়টি দেখে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। এর পর আকাশ চালকের আসনের ওপরে টাকাভর্তি একটি ব্যাগ দেখে। এত টাকা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে আকাশ তার আরেক ভাইকে ফোন করে উত্তরা এলাকায় আসতে বলে। আকাশের ওই ভাইও গাড়িচালক। সকাল ১০টার দিকে ভাই গাড়ি নিয়ে আসার পর আকাশ টাকাভর্তি ব্যাগটি তার কাছে দেয়। এর পর ট্রাঙ্কভর্তি টাকার ব্যাগ নিয়ে আকাশ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে থাকে। আকাশ দাবি করেছে– প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওই দিন একটি হাসপাতালে গেছে সে।এরই মধ্যে পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে খবর পায়, একটি মাইক্রোবাস টাকা ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই মাইক্রোবাসের মালিক পুলিশের একজন সার্জেন্টের ভাই। খবর পেয়ে পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে মাইক্রোবাসের চালক আকাশকে পৌনে ৪টার দিকে খিলক্ষেত এলাকায় পায়। তদন্তে আরও উঠে এসেছে, ছিনতাই অপারেশন পরিচালনা করতে ডাকাত চক্রটি ৬-৭টি নতুন মোবাইল ফোন ও সিম কিনেছে। পরিকল্পনার সময় তারা এসব সিম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত। আর মানি প্লান্টের টাকা লুট করে একটি ফাঁকা ট্রাঙ্ক ৩০০ ফিট এলাকায় ফেলে গেছে ডাকাত দলের সদস্যরা। ওই এলাকা থেকে ট্রাঙ্কটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সফল ছিনতাই মিশনের পর সোয়া ঘণ্টা টাকাভর্তি মাইেক্রাবাসে ছিল ডাকাত দল। এ ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা কেন, কোথায় আকাশ এলামেলো ঘোরাঘুরি করেছে– এই বিষয়গুলো তদন্ত করা হচ্ছে।এখন পর্যন্ত উদ্ধার ৬ কোটি ৪৩ লাখ: ডিবির মিরপুর বিভাগ ও উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন টিম ঢাকা ও সুনামগঞ্জে অভিযান চালিয়ে লুট হওয়া আরও ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করেছে। এ নিয়ে মোট ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সানোয়ার হাসান, ইমন ওরফে মিলন, আকাশ মাদবর ও সাগর মাদবরকে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার চারজন হলো– বদরুল আলম, মো. মিজানুর রহমান, মো. সোনাই মিয়া ও মো. এনামুল হক বাদশা।ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, অভিযানে বনানী থেকে সানোয়ার হাসান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা। একই এলাকা থেকে মো. ইমন ওরফে মিলন নামে আরেকজনকে ধরা হয়। পরে জোয়ার সাহারা এলাকায় তার বাসা থেকে ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। এ ছাড়া উত্তরা থেকে আকাশ ও তার ভাই সাগর নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাসা থেকে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং অপরাধকর্মে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ এলাকায় অপর একটি দলের অভিযানে অন্য চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বুথের জন্য টাকা বহনকারী গাড়িটির নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য আগে থেকেই তাদের কাছে ছিল। গাড়িটি কাছাকাছি এলে তারা অনুসরণ শুরু করে। তারা গাড়িটিকে একবার অতিক্রম করে আবার পেছনে চলে যায়। নির্জন জায়গায় যাওয়ার পর এক পর্যায়ে টক্কর লাগিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে। পরে গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।টাকা পরিবহনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির গাফিলতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সোয়া ১১ কোটি টাকা পরিবহনের সময় ওই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা অর্থাৎ গার্ডের জন্য অস্ত্রসহ কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন না। অধিকাংশ সময় এভাবে বেশি টাকা পরিবহন করা হয়, যা বিপুল টাকার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। টাকা পরিবহনের সময় স্থানীয় থানাকে তারা জানায়নি। ডিবির অভিযান চলমান। বাকি টাকা ও অন্যান্য আসামি শিগগিরই গ্রেপ্তার হবে।এদিকে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া এই ঘটনার আদ্যোপান্ত বের করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।২০১২ সালে গাজীপুরে মানি প্লান্ট লিঙ্ক কোম্পানি বুথে টাকা জমা দিতে গেলে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। সাত ব্যাংককে তারা এই সেবা দিচ্ছে। তাদের গানম্যান রয়েছে তিনজন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানি প্ল্যান্টের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে ডাকাত দলের কাছে গেছে। একজন প্রকৌশলী সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন।মানি প্লান্ট লিঙ্ক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ বলেন, আশা করি, বাকি টাকা দ্রুত উদ্ধার হবে। চারটি ট্রাঙ্কে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিল–এতে সন্দেহ নেই। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অর্থ এটিএম বুথে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি অনেক দিন করে আসছি।সুনামগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার চারজন চিহ্নিত অপরাধী: এদিকে সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এ ঘটনায় সুনামগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার চারজনই চিহ্নিত অপরাধী। সোনাই মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের লম্বাহাটি এলাকায়। তার বাবার নাম অহিনুর মিয়া। চুরি, ছিনতাই, বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাসহ ৯টি মামলায় গত পাঁচ বছরে কয়েকবার জেলে ছিল সে। এনামুল হক বাদশা এলাকায় ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত।স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর আবাবিল নুর জানিয়েছেন, অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েক বছর আগেই বাদশার পরিবারকে এলাকাছাড়া করেন। গ্রেপ্তার বদরুল ইসলাম শহরের বড়পাড়ার ছমির উদ্দিনের ছেলে। এলাকার লালশাদ মিয়ার ছেলে সাঈদুল হককে চার বছর আগে ছুরিকাঘাতে খুন করেছিল সে। চুরির মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। কয়েক দিন হয়েছে বের হয়ে এসেছে সে।সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি (তদন্ত) ওয়ালি আপ্তাব খান জানিয়েছেন, ওই চারজন জামিনে বের হয়ে বারবার নানা অপরাধে যুক্ত হয়।