
শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকেই রাজধানীতে চলছে পানির সংকট। দিন দিন তা প্রকট হয়ে উঠছে। দিনের পর দিন অনেক এলাকার পাইপলাইনে পানির দেখা মিলছে না। গাড়িতে করে অতিরিক্ত দামে পানি কিনে কোনো রকম দিন পার করছেন ভুক্তভোগীরা। সেই পানির জন্যও করতে হচ্ছে দেনদরবার। যেসব এলাকায় কমবেশি ওয়াসার পানি মিলছে, তার মানও ভালো না। অনেক ক্ষেত্রেই ময়লা-দুর্গন্ধ। দক্ষিণ সিটি এলাকায় এই সংকট বেশি। তবে ঢাকা ওয়াসার দাবি, পানির কোনো সংকট নেই।প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ পানির জন্য আন্দোলন করে আলোচনায় আসা জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা ওয়াসার এমডিকে শরবত খাওয়ানোর চেষ্টার চার বছর পার হলেও জুরাইন এলাকার অবস্থার বদল হয়নি। জুরাইনের ঋষিপাড়া, কুসুমবাগ, পুকুরপাড়, নবীনবাগ, চেয়ারম্যান বাড়িসহ ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের অনেক এলাকায় এখনও ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। আগে একেবারে পানি না পাওয়া এলাকার সংখ্যা খুব কম ছিল। এখন অবস্থা আরও খারাপ। পানি যেটুকু পাওয়া যায়, তাও মান ভালো না।তিনি বলেন, মসজিদ ও কয়েকটি স্থানে বসানো ওয়াসার ডিপ টিউবওয়েল থেকে মানুষ পানি কিনে ব্যবহার করছে। তিনি টিউবওয়েলের পানিও দু’বার পরীক্ষা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি থেকে। প্রত্যেকবারই পানিতে জীবাণু পাওয়া গেছে।মিরপুর সেকশন ৭ এর ১, ২ ও ৩ নম্বর সড়কের শতাধিক ভবনে ঠিকমতো পানি মিলছে না বলে জানান স্থানীয়রা। রামপুরা বনশ্রীর ডি ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ১/২ নম্বর হোল্ডিংয়ের রেডিয়্যান্ট কৃষ্ণচূড়া ভবনের বাসিন্দা মীর আব্দুল আলিম অভিযোগ করেন, তিন দিন ধরে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ নেই। সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কাজ হচ্ছে না।স্থানীয়রা জানান, তিন দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া এবং গোসলের পানি মিলছে না। ওয়াসা ছাড়াও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ওয়াসা সাপ্লাই উইং) খায়রুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান হয়নি।মগবাজারের চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা নাজনীন আহমেদ বলেন, পাঁচ বছর ধরে এ এলাকায় থাকি। এর মধ্যে কয়েকদিন পানির সমস্যা হয়েছিল। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে লাইনে পানি আসছে না।মাতুয়াইলের ডগাইর এলাকার মাজার রোডের বাসিন্দা মোস্তফা বলেন, কয়েক দিন ধরে এ এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহ নেই। ওয়াসার পাইপলাইন ফেটে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে শুনেছি। তাই বাধ্য হয়ে পানি কিনে এবং যেসব স্থানে গভীর নলকূপ বসানো আছে, সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে তাঁদের দৈনন্দিন কাজ করতে হচ্ছে।দয়াগঞ্জ মোড়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, তাঁর বাসায় কয়েক দিন ধরে পানির সমস্যা চলছে। রাতে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য একবার আসে। সেই পানি দিয়ে সারাদিন পার করতে হয়। পাশের বেগমগঞ্জ ও স্বামীবাগ এলাকারও কিছু বাড়িতে সপ্তাহখানেক ধরে পানি নেই বলে জানান তিনি।মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেখেরটেক এলাকায় দুই মাস ধরে বাসাবাড়ির লাইনে ঠিকমতো পানি না পাওয়ায় বাসিন্দারা ভোগান্তিতে আছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওয়াসার হেল্পলাইনে বারবার ফোন দিলেও কেউ ধরে না। তাঁরা জানান, এলাকায় ওয়াসার প্রধান পানির পাম্পটি নষ্ট। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির অফিসে বারবার ধরনা দিলেও সেটি ঠিক হয়নি। স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী রফিক আহমেদ জানান, বাসায় পানি না থাকায় বাধ্য হয়ে যাঁরা ওয়াসার গাড়ি থেকে পানি কিনছেন, সেখানেও ৪০০ টাকার বদলে ৬০০-৮০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। ঠিক সময়ে আসছে না পানির গাড়ি।এ ছাড়া রাজধানীর স্বামীবাগ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, কুড়িল, ভাটারা, রূপনগর, কালাচাঁদপুর, মিরপুর, আগারগাঁও, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, আদাবর, উত্তরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক দিন ধরেইএসব এলাকায় পানির সংকট চলছে। কিছু এলাকার পানিতে ময়লাও পাচ্ছেন এলাকাবাসী।উত্তরার তুরাগ, কামারপাড়া, ফুলবাড়িয়া, বটতলায় প্রায় ১৫ দিন ধরে পানির সমস্যা চলছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। তাঁরা জানান, দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টার জন্য পানি আসে।অবশ্য ঢাকা ওয়াসার মুখপাত্র মোস্তফা তারেক দাবি করেন, তাঁদের পানির কোনো সংকট নেই। প্রতিদিন ২৬৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে ঢাকা ওয়াসা, যা চাহিদার চেয়ে কম নয়। কাজেই পানির কোনো সংকট থাকার কথা না। তবে দু-একটি স্থানে পকেট সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেখানে গাড়িতে করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিদিন শত শত মানুষ ঢাকা ওয়াসার কল সেন্টারে গাড়িতে করে পানি সরবরাহ করার চাহিদার কথা জানাচ্ছেন। সেই চাহিদা অনুযায়ী পানি দিতে পারছে না ওয়াসা। প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার গাড়ি চাহিদার বিপরীতে ১ হাজারেরও কম গাড়ি পানি দিতে পারছে। বাকি গ্রাহকরা পানি থেকে বঞ্চিত থাকছেন। কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, লোডশেডিং ও জেনারেটরের স্বল্পতার কারণে পানি উৎপাদন কমে গেছে। অথচ উৎপাদনের ৬৬ শতাংশ পানি আসে ডিপ টিউবওয়েল থেকে। এ জন্যই পানির সংকট তৈরি হয়েছে।
