রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার এখনই সময়


খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র। বোধপায়ার আরাকান দখলের পর স্বাধীন দেশের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় কক্সবাজারে, মগরা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশের আরাকান দখলের পর উদ্বাস্তুরা ফিরে যায় নিজ বাসভূমিতে। বৌদ্ধ মগ ও মুসলমান রোহিঙ্গাদের মধ্যে সমদূরত্বসম্পন্ন সহাবস্থানের কাল ছিল ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। ১৯৪২ সালে জাপানের বার্মা দখলের সুযোগ নিয়ে থাকিনদের উৎসাহে জাতি বৈরিতা প্রকট আকার ধারণ করে। বৌদ্ধরা জাপানের পক্ষে এবং রোহিঙ্গারা ব্রিটিশের পক্ষে যোগদান করে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। জাপানের অগ্রাভিযানের সময় বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে হামলা চালায়, ব্রিটিশের অগ্রাভিযানের সময় রোহিঙ্গারা হামলা চালায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের গ্রামে। মংডুতে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু, তারা হামলা চালায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে। রাচিডংয়ে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যালঘু, সেখানে হামলা চালায় বৌদ্ধ মগরা। দুই সম্প্রদায়ের হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে ‘রোহিঙ্গাকাটা’ ও ‘মগকাটা’ হিসাবে নিন্দিত হয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমানাপ্রাচীর এতটা অভ্রভেদী হয়ে ওঠে যে, মুসলমানদের মধ্যে মংডু, বুথিডং ও রথিডং নিয়ে পৃথক আবাসভূমি তৈরির স্বপ্ন প্রবল হয়ে ওঠে।জামিয়াতুল-উলেমা-ই-ইসলাম ১৯৪৪ সালে করাচিতে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে, মুসলিম লীগ নেতাদের সমর্থন পাওয়ার আশায়। ১৯৪৬ সালের মে মাসে আরাকানে জনমত তৈরি হয় দুইভাবে। এর একটি ছিল পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং অন্যটি ছিল কালাদান ও মায়ো নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এমন সময়ে এ জনমত তৈরি হয়, যখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই রাষ্ট্রের বদলে এক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে চূড়ান্ত হয়। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে মৌলভি লোকমান নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেই দেখা করেন জিন্নাহ্র সঙ্গে। কিন্তু জিন্নাহ্ পাকিস্তানে দুই রাষ্ট্রের ধারণা বধ করে নীতিগতভাবে আরাকানে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বিরক্তিকর মনে করেন। নাফ নদীর এপারে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, ওপারে অং সান ছিলেন নিজের পেটের ভেতরে বিভাষী ক্যাঙারুর বাচ্চা বহনের বিষয়ে নিরুৎসাহী। উভয়ের প্রধান শত্রু ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, উভয়ে বিরোধী ছিলেন বাংলাভাষীদের স্বাধীনতা দানের বিষয়েও।১৯৪৮ সালে জাফর কাওয়াল কালাদান নদীর পশ্চিম পার থেকে নাফ নদীর পূর্ব পার পর্যন্ত এলাকায় স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন। রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ভারতের প্রিন্সলি স্টেট হায়দরাবাদ। জাফর কাওয়াল সেপ্টেম্বরে যে ৫ দফা দাবি পেশ করেন, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল-১. আকিয়াবে স্বায়ত্তশাসিত মুসলমান রাজ্য গঠন। ২. উর্দু হবে রাজ্যের ভাষা, যেমন ছিল হায়দরাবাদে। ৩. স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম হবে উর্দু। যখন তিনি এ প্রস্তাব পেশ করেন, তখন রোহিঙ্গারা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, ১৯৪৯ সালে আরাকান কম্যুনিস্ট পার্টি (এসিপি) নেতা অং প্রু এএফপিএফএল সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত একত্রে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেন; এই শর্তে যে, কালাদান নদীর পশ্চিম প্রান্ত নিয়ন্ত্রণ করবে মুজাহিদ দল, বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণ করবে কম্যুনিস্ট পার্টি।চল্লিশের দশকের পরাক্রান্ত মুজাহিদ বাহিনী পঞ্চাশের দশকে হীনবল হয়ে যায়। তার নেতা কাসেম রাজা ১৯৫৪ সালে সপরিবারে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেওয়ার পর আরাকানে ‘ফুরুইক্ষ্যা’ বাহিনীর জন্ম হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সীমান্তে তৎপর ছিল ‘ফুরুইক্ষ্যা’ বাহিনী। তবে সত্তরের দশকের শেষদিকে এসে দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পোড়ামাটি নীতির কারণে। নে উইন বোধপায়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। তখন থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের বার্মা ত্যাগের নতুন পর্ব, অন্যদিকে শুরু হয় মগদের বাংলাদেশ ত্যাগের পর্ব। ইংরেজদের অভিবাসন নীতির কারণে উনিশ শতকের শেষ দশকে যেভাবে আরাকান মুসলমানপ্রধান হয়ে ওঠে, এর বিপরীত আদর্শে একশ বছর পর বিশ শতকের শেষ দশকে এসে মুসলমানশূন্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তাতমাদোর অভিযানের পর দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১২ সালে জাতিগত দাঙ্গার পর গঠিত হয় ফুরুইক্ষ্যা আল ইয়াকিন (আরাকানি ভাষায় গেরিলা অর্থে প্রুইক্ষ্যা শব্দটি ব্যবহৃত হয়, রোহিঙ্গা উচ্চারণে প্রুইক্ষ্যা হয়েছে ফুরুইক্ষ্যা। পরে এর নামকরণ করা হয় আরসা)। ২০১৭ সালে পালিয়ে আসে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মগরা থাকিনদের সহযোগিতায় যেভাবে ‘রোহিঙ্গাকাটা’য় অবতীর্ণ হয়, একইভাবে অবতীর্ণ হয় ২০১৭ সালে।২০২৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দাবার দান উলটে যায়, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানসংক্রান্ত আইন পাশ করার পর। ১৯৮২ সালে যেসব রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অন্তত দুই বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরির শর্তে তাদের লাল কার্ড ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, জান্তা সরকার এ আইনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করে আরাকানের অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাতের কথা মাথায় রেখেই। লক্ষণীয়, থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে রোহিঙ্গাদের কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নেই। এরই সুযোগ গ্রহণ করে জান্তা প্রশাসন, বুথিডংয়ে রোহিঙ্গাদের রাজপথে নামিয়ে বিক্ষোভ নাটকের আয়োজন করে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া ও দেশ থেকে নির্বাসিত করার হুমকি দিয়ে নতুন নাটকে মূকাভিনয় করানো হয় রোহিঙ্গাদের দিয়ে। প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়, ‘আমরা আরাকান আর্মি চাই না, আমরা চাই না কোনো যুদ্ধ’। বাধ্য করা হয় রোহিঙ্গাদের জান্তা সরকারে পক্ষ নিতে, যেমনভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান রোহিঙ্গাদের বাধ্য করেছিল জাপানিদের পক্ষ নিতে। স্মরণীয়, ডানবেইকে ব্রিটিশদের ব্যর্থ অভিযানের পর (১৮ মার্চ ১৯৪৩) মংডু পর্যন্ত জাপানি দখলদারিত্ব কায়েম হলে রোহিঙ্গারা বাধ্য হয় জাপানিদের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৩ সালের আগস্টে শীতের শুরুতে জাপানিদের পিছু হঠার আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা জাপানকে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয় ভলান্টিয়ার হিসাবে। একই কায়দায় বর্তমান সরকার বশীকরণ নীতিতে মংডুতে বৈঠক আয়োজন করে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে।মংডুর ঘটনা আমাদের আরও মনে করিয়ে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মংডুতে মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির বৈঠকের কথা। শুধু পার্থক্য হলো-১৯৪২ সালের মে মাসে বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছিল জাতিগত দাঙ্গা নিরসনের জন্য, ২০২৪ সালে বৈঠক আহ্বান করা হয় জাতিগত দাঙ্গা উৎসাহিত করার জন্য। জান্তা সরকার মংডু ও বুথিডংকে বেছে নেয় এজন্য যে, এ দুটি এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রথিডং এরই মধ্যে দখল হয়ে যাওয়ার পর জাতিগত বিভেদ নীতির দরকার হয়। সামরিক সরকার এখন চাচ্ছে ধনুকাকৃতির যুদ্ধরেখার দুই প্রান্তে দুই জনগোষ্ঠীকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে, যার এক প্রান্তে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রথিডং, অন্য প্রান্তে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথিডং ও মংডু।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এ যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাপান ও ব্রিটিশ অনুপস্থিত। তবে জাপানের অনুপস্থিতিতে তার একসময়ের সহযোগী এখন আবির্ভূত নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে। নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে আরাকান আর্মি। যুদ্ধটা বলা যায় মামা-ভাগিনাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ; সেখানে শুধু ব্রিটিশই অনুপস্থিত নয়, ব্রিটিশের সহযোগী রোহিঙ্গারাও অনুপস্থিত। আরাকানের রঙ্গমঞ্চে জাপান ও জাপানের সহযোগীরা প্রধান কুশীলব, শুধু ব্রিটিশ ও ব্রিটিশের সহযোগীরা একেবারেই অদৃশ্য। এ অবস্থায় আরাকান স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত যেভাবেই আবির্ভূত হোক-বৌদ্ধরা হবে প্রধান শক্তি। এখানেই তৈরি হয়েছে প্রধান আশঙ্কা। এ সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের সর্বাগ্রে যা করতে হবে তা হলো-আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঅধিকারের চুক্তি সম্পাদনের পর জান্তাবিরোধী যুদ্ধে এখনই অংশ নিতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে আরাকান আর্মির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আরাকান আর্মি ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে, তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আরাকানে ফিরে আসার। আরাকান আর্মির সঙ্গে চুক্তি করে এখনই পুনর্বাসিত হতে পারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশকে নির্বাসনে রেখে রচিত হয় বার্মার বৈষম্যপূর্ণ সাংবিধানিক ইতিহাস। এবার তার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে নির্বাসিত রেখে আরাকানের ভাগ্য নির্ধারিত হলে সেটি হবে আরেকটি ক্ষমাহীন ভুল।ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজmahmoodnasirjahangiri@gmail.com