শুধু শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হবে না
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

বলা হয়, এই যুগে জীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে একাডেমিক সার্টিফিকেট আর খুব একটা কাজে আসে না। কারও বুদ্ধি থাকলে তার সার্টিফিকেট থাক বা না থাক, সে জীবনে সফল হবেই। উদাহরণ হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেকসপিয়র বা বিল গেটসের নাম চলে আসে। কিন্তু এসব আলোচনায় যেখানে একটা ফাঁক থেকে যায়; সেটা হচ্ছে \'বুদ্ধি\' শব্দটার সংজ্ঞায়। আমরা যখন \'বুদ্ধি\' শব্দটা ব্যবহার করি, তখন সাধারণত ভাষিক, গাণিতিক ও যৌক্তিক বুদ্ধিকে বোঝাই। হাওয়ার্ড গার্ডনার যে আরও ছয় রকম বুদ্ধির কথা বলেছেন। যেমন আন্তঃব্যক্তিক, অন্তঃব্যক্তিক, প্রাকৃতিক, সাংগিতিক, স্থানিক এবং শারীরিক বুদ্ধিও যে এক ধরনের বুদ্ধি- সেটা মাথায় রাখি না।যা হোক, এই বুদ্ধি মাপার জন্য আমরা যে টেস্ট ব্যবহার করি, সেই আইকিউ টেস্টের একজন বড় বিশেষজ্ঞ হলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক লুই টারম্যান। প্রথম মহাযুদ্ধের পরপর টারম্যানের সঙ্গে হেনরি কাওয়েল নামে এক বালকের দেখা হয়। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই বালকটি একটি স্কুলে জ্যানিটরের কাজ করত, আর সুযোগ পেলেই কাজে ফাঁকি দিয়ে স্কুলের পিয়ানোতে বসে অসাধারণ সব সুর তুলত। টারম্যান আন্দাজ করলেন, এর আইকিউ নিশ্চয় অসাধারণ হবে। সত্যিই তাই। কাওয়েলের স্কোর হলো ১৪০-এর ওপর। এই ঘটনার পর টারম্যান ক্যালিফোর্নিয়ার ২ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর আইকিউ টেস্ট করে সেখান থেকে ১৪০ থেকে ২০০ নম্বর পাওয়া ১ হাজার ৪৭০ জনকে বাছাই করলেন। আইকিউর কী প্রভাব এদের জীবনে পড়ে, সেটা পরবর্তী ৩০ বছর ধরে লক্ষ্য করলেন। দেখলেন, তাদের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত জীবনে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না। এর বেশ কিছু কারণ ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দারিদ্র্য, সুযোগ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।
এখন অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সৃজনশীলতা না থাকলে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীলতার চর্চা কিংবা মূল্যায়ন হয় না। মুখস্থ বিদ্যা ছাড়া যে বিষয়টার কিছু চর্চা ও মূল্যায়ন হয়, সেটা বুদ্ধি। বিভিন্ন বিষয় বিশ্নেষণ করে কত দ্রুত এবং ভালোভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন, সেটা আপনার বুদ্ধি। আর একটা বিষয়কে কতভাবে দেখতে পান এবং তার ওপর কত ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেটা সৃজনশীলতা। এ কারণেই \'স্ট্যানফোর্ড-বিনেট আইকিউ টেস্ট\' বা \'রেভেন্স প্রোগ্রেসিভ ম্যাট্রিসেস টেস্ট\' দিয়ে যখন একজন মানুষের বিমূর্ত যৌক্তিক বুদ্ধি মাপা হয়, তখন সাধারণত কনভার্জেন্স টেস্ট ব্যবহার করা হয়। যিনি এই পরীক্ষা দেন তাঁর কাজ হচ্ছে টেস্ট প্রস্তুতকারীর চিন্তার সঙ্গে নিজের চিন্তাকে মিলিয়ে নেওয়া।
অন্যপক্ষে মানুষের সৃজনশীলতা মাপতে হয় ঠিক উল্টোভাবে। \'কনভার্জেন্স টেস্ট\'-এর বদলে \'ডাইভার্জেন্স টেস্ট\' দিয়ে। এখানে পরীক্ষার্থীকে কোনো প্রশ্ন করে বা কোনো সমস্যা সমাধান করতে বলে তার কাছ থেকে কেবল একটি উত্তর বা একটি সমাধান আশা করা হয় না। একজন পরীক্ষার্থী যত বেশি উত্তর বা সমাধান দিতে পারবে, সে তত সৃজনশীল।লিয়াম হাডসন তাঁর বই \'কনট্রারি ইমাজিনেশনস :এ সাইকোলজিক্যাল স্টাডি অব দ্য ইংলিশ স্কুল বয়\'তে কনভার্জেন্স টেস্টের বর্ণনা দিয়েছেন। আইকিউতে অসাধারণ একজন ছাত্র ফ্লোরেন্সকে যখন \'ইট\' আর \'কম্বল\' শব্দ দুটিকে কতভাবে ব্যবহার করা যায় তা লিখতে বলা হলো, সে লিখল- \'ইট\' দিয়ে বিল্ডিংও বানানো যায় আবার সেটা ছুড়েও মারা যায়। \'কম্বল\' দিয়ে শরীর গরম রাখা যায়, আগুন নেভানো যায়, গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে হ্যামক বানিয়ে সেখানে ঘুমানো যায় এবং রোগীকে বহন করার জন্য সেটাকে স্ট্রেচার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
ফ্লোরেন্সের চেয়ে আইকিউতে অনেক খারাপ নম্বর পাওয়া একজন ছাত্র পুলকে যখন লিখতে দেওয়া হলো, তখন সে লিখল, \'ইট\' দিয়ে দোকান ভেঙে সেটা লুট করা যায়, বাড়ি বানানো যায়। রাশান রুলেট খেলতে খেলতে কেউ যদি শরীরচর্চা করতে চায়, সে ইট ব্যবহার করতে পারে; পালকের লেপ খাটের ওপর বিছিয়ে সেটাকে স্থির রাখতে চাইলে তার দু\'দিকে দুটো ইট ঝুলিয়ে দেওয়া যাতে পারে এবং ইট দিয়ে কোকা-কোলার বোতল ভাঙা যায়। আর \'কম্বল\' বিছানায় ব্যবহার করা যায়, অরণ্যে অবৈধ প্রেম ঢাকার কাজে লাগানো যায়, আগুন ধরিয়ে ধোঁয়ার সংকেত পাঠানো যায়, তাঁবু বানানো যায়; নৌকা, গরুর গাড়ি বা স্লেজ গাড়িতে পাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়; টাওয়েল হিসেবে ব্যবহার করা যায়; চোখে কম দেখে এমন মানুষের শুটিং প্র্যাকটিসের জন্য টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং এটা মেলে ধরে জ্বলন্ত অট্টালিকা থেকে লাফিয়ে পড়া মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায়।
বোঝাই যাচ্ছে, ফ্লোরেন্সের চেয়ে পুলের আইকিউর স্কোর কম হলেও তার সৃজনশীলতা অনেক উঁচু মানের। পুলের এই সৃজনশীলতা সে তার ব্যক্তিগত চেষ্টায় অর্জন করেছে। কারণ স্কুলে এই সৃজনশীলতার চর্চা ও মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। উল্টো নিরুৎসাহিত করা হয়। এমন প্রায়ই দেখা যায়, কোনো শিক্ষার্থী নিজের চেষ্টায় কিছু লিখল। তো ভালো নম্বর না দিয়ে তাকে বরং ধমক দেওয়া হলো। অঙ্ক ঠিক হওয়ার পরও শুধু শিক্ষকের দেখানো পদ্ধতির সঙ্গে তার পদ্ধতি মিলল না বলে সে শূন্য পেল।
শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করে গড়ে তোলার প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের স্বাধীনভাবে কল্পনা করার সুযোগ এবং উৎসাহ দেওয়া। অনেকেরই হয়তো পুলের মতো কল্পনাশক্তি আছে। কিন্তু আমরা তাদের চারদিকে এত মানসিক দেয়াল তৈরি করে রাখি এবং তাদের ফ্লোরেন্সের মতো শুধু বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য এত প্রলুব্ধ করি যে, চর্চার অভাবে সেই শক্তিটা এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়।আশার কথা, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথমবারের মতো এই বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে; তবে তা যথেষ্ট নয়। কল্পনার রাশ টেনে ধরার সংস্কৃতি আমাদের অস্থিমজ্জায় এমনভাবে মিশে গেছে, এ ক্ষেত্রে অভিভাবক এবং সমাজের অপরাপর মানুষ এগিয়ে না এলে শুধু শিক্ষক ও শিক্ষাক্রম দিয়ে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ \'সৃজনশীলতা\' অর্জন করা যাবে না।
