শোধ করতে হবে জাতির পিতার রক্তের ঋণ


বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক, বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্নসারথি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মনে-প্রাণে, চিন্তায়-চেতনায়, বিশ্বাসে-ভাবনায়, অস্তিত্বে তিনি একজন নির্ভেজাল বাঙালি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতির নব উন্মেষের জন্য ছিল তার আমৃত্যু সংগ্রাম। একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির অনবদ্য ভূমিকায় তিনি ছিলেন অনন্য উচ্চতায় আসীন। বাঙালি জাতির তার কাছে রয়েছে অশেষ ঋণ। ইতিহাসের কালজয়ী এ মহামানব তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাঙালির প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা লিখে গেছেন এভাবে, ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতিকে নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ অদম্য আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ, মানবিক ঔদার্য, নির্মোহ আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির আহ্বান আর অগাধ দেশপ্রেম বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত করেছিল। তিনি বাঙালি জাতির জন্য অন্ধকারে একমাত্র আলোর দিশারি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিতের কণ্ঠস্বর। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার যোগ্যতা কী?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে ভালোবাসি।’ ডেভিড ফ্রস্ট পালটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি তাদের খুব ভালোবাসি।’ একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আমেরিকার এমবিসি চ্যানেলের সাংবাদিক পল নিক্সনকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি কোটি, কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা পেয়েছি। তাদের জন্য প্রাণ দিতে পারলেও আমি নিজেকে সার্থক মনে করব।’ ১৯৭১ সালে ঢাকায় কর্মরত আমেরিকার কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড তার লেখা বই ‘The Cruel Birth of Bangladesh: Memories of an American Diplomat’-এ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘Mujib\'s very appearance suggested rwa power, a power drawn from the masses and from his strong personality’. একজন বঙ্গবন্ধুই বাঙালির শৌর্যবীর্য আর অহংকারের প্রতীক। তিনিই একটি জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নামে নতুন সৃষ্ট রাষ্ট্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা জানা যায় ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে দেওয়া তার এক ভাষণ থেকে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু কল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্রের চিন্তা করেছিলেন। এমন একজন বাঙালি অন্তঃপ্রাণ কীর্তিমান পুরুষকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমন বর্বোরচিত হত্যার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই। অথচ অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বাঙালিদের। কোনো বাঙালি তার ক্ষতি করতে পারে এটা বঙ্গবন্ধু দূর কল্পনাতেও কখনো আনতে পারেননি। অথচ কী নির্মম পরিহাস! যে বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের সব আত্মত্যাগ, সব প্রচেষ্টা আর সাধনা, সে বাঙালির হাতেই কিনা তার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ৩২ নম্বরের সিঁড়ি। তাই তো কবি রফিক আজাদ লিখে গেছেন, স্বপ্ন তার বুক ভরে ছিল/পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ/এদেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র/তার চোখে মূল্যবান ছিল/নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল/স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে পড়ে আছে/বিশাল শরীর/তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে/সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ/তার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে/মানচিত্র ঢেকে দেয় সস্নেহে, আদরে! একটি জাতির অস্তিত্ব ও বিকাশে বঙ্গবন্ধুর যে আপসহীন সংগ্রাম আর অপরিসীম আত্মত্যাগ, তা ইতিহাসে বিরল। বাঙালির ইতিহাস যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অবশ্যই সগৌরবে উচ্চারিত হবে। বঙ্গবন্ধুকে কেনই বা হত্যা করা হয়েছিল? কারা এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলব? কারা ছিল এ হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী? ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জেনেও সে সময় কারা নীরব ছিল? কাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল? কারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়েছিল? শোকাবহ আগস্ট মাস এলেই এ প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসে বারবার। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। জাতি হিসাবে এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। তা না হলে আমাদের সবাইকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। জাতির পিতার রক্তের ঋণ যদি আমরা শোধ করতে চাই, এ দেশকে, এ জাতিকে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি করতে চাই; তাহলে আর কালবিলম্ব না করে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। অধিকতর তদন্ত করতে হবে ইতিহাসের এ নির্মম ও মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর সরাসরি হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তদের বিচার হলেও ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। সে সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি তথা কর্মকর্তাদেরও বিচারের আওতায় আনা যায়নি। তাদের সবার বিচার হওয়া আজ জরুরি। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের দেশি-বিদেশি কুশীলবরা এখনো বেঁচে আছে। সুযোগ পেলেই তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা জরুরি। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডে প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে ওই কমিশনে ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজ। তবে অনুসন্ধান কাজে ওই কমিশনকে বাংলাদেশের ভিসা দেয়নি জিয়াউর রহমান সরকার। এছাড়া জাতির পিতার খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন এবং সংসদে নিয়ে আসার কাজটিও ধারাবাহিকভাবে করেছে জিয়াউর রহমান সরকার, এরশাদ সরকার ও খালেদা জিয়া সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে সেটিকে সংবিধানের অংশ বানিয়েছেন জিয়াউর রহমান। ইতিহাসের অনিবার্যতায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী, পৃষ্ঠপোষক, সমর্থক, বাস্তবায়নকারী ও উপকারভোগীদের স্বরূপ উন্মোচন করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, এ দেশের নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের যিনি মুক্তিদাতা, সেই অবিসংবাদিত মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রনায়কদের হত্যাকারীদের বিচার যেমন হয়েছে, পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারীরাও বিচারের আওতায় এসেছে। সে জন্য দেশে দেশে নানা কমিশন গঠন করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার বিচার হয়েছে, তেমনি তার হত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচনের জন্য গঠন করা হয়েছে ওয়ারেন কমিশন। ভারতেও মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন হয়েছে; পাশাপাশি হত্যার ষড়যন্ত্র উদঘাটনের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচনেও তদ্রূপ একটি কমিশন গঠন আজ সময়ের দাবি। সে তদন্ত কমিশনকে ষড়যন্ত্রের একেবারে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সার্বিক বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। এগুলো বিচারিক আদালতে বিচার ও শাস্তি হওয়ার একটি বিষয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্যই উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যা থেকে প্রাপ্ত তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করা হবে। যেটি আগামী প্রজন্মের কাছে জাতির পিতার হত্যার ও ষড়যন্ত্রের অনবদ্য দলিল হিসাবে উপস্থাপন হবে। আমরা কৃতজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচারের কথা বলে আমাদের সে দায় মোচনের সুযোগ করে দিয়েছেন। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের বিচার হলেও স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় অন্তরালে থেকে যারা জাতির পিতার হত্যার ছক করেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তদন্ত কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনলে এদেশ জাতির পিতার হত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে। জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করার প্রচেষ্টা খানিকটা হলেও সফল হবে। আমরা চাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিচার হোক। যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ইতিহাসের এ কলঙ্ক থেকে জাতিকে দায়মুক্তি দেওয়ার শিক্ষা নিতে পারে। এখনই এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ছাড়া এটি কোনোদিন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। শেষ করতে চাই কবি সৈয়দ শামসুল হকের ‘পনেরো আগস্ট’ কবিতার কটি লাইন স্মরণ করে : এখনো রক্তের রঙ ভোরের আকাশে/পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে/কবে থেকে ভাসছে বাতাসে/অপেক্ষায় শব্দের-শব্দেই হবে সে মুখর আরো একবার/জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার/পাখায় পড়বে এসে/ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে/মানুষতো ভয় পায় বাকহীন মৃত্যুকেই/তাই ওঠে নড়ে/থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে। শ ম রেজাউল করিম : মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়