শ্মশানের জমিতেও সাবেক এমপি রণজিতের থাবা!


যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনে তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য (এমপি) রণজিত কুমার রায়ের হাত থেকে রেহাই পায়নি বাঘারপাড়ার খাজুরা কেন্দ্রীয় শ্মশানের জমিও। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চাঁদার টাকায় কেনা শ্মশানের ৭৭ শতক জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন তিনি। এক হিন্দু শিক্ষকের প্রায় চার একর জমি লিখে নিয়ে টাকা দেননি। ওই শিক্ষকের পরিবার ভয়ে এলাকা ছেড়েছে।সংসদ-সদস্য পদ যেন তার কাছে ‘আলাদিনের চেরাগ’ ছিল। ১৫ বছরে দখল, নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য, সরকারি প্রকল্পে লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক শ কোটি টাকা কামিয়েছেন রণজিত কুমার রায়। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। টিনের বাড়ি থেকে অসংখ্য বিলাসবহুল বাড়ি ও জমির মালিক বনে গেছেন তিনি। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রণজিত কুমার রায়ের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।শ্মশানের জমিতেও থাবা : যশোর বাঘারপাড়া উপজেলার ধান্যকুড়া মৌজায় অবস্থিত খাজুরা কেন্দ্রীয় শ্মশান। এখানে খাজুরা এলাকার সাত গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকার করা হয়। নিজস্ব জমি না থাকায় চিত্রা নদের পাড়েই সরকারি জমিতে শ্মশানের কাজ করা হতো। নদ খনন করার সময় শ্মশান বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। এলাকার মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে শ্মশানসংলগ্ন ৭৭ শতক জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৩৫নং ধান্যকুড়া মৌজায় ১৪৩ দাগের সাত শতক ও ১৩৭ দাগের ২৪ শতক মোট ৩১ শতক জমি ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আল আমীন মন্ডলের ছয় ওয়ারিশ রণজিত রায়ের নামে জমি লিখে দেন। যার দলিল নং ৩৭৪৮। দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা। একই মৌজার ১৩৬নং দাগের ৪৬ শতক জমি ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর কাজী রবিউল ইসলাম ও তার মা-সহ বাকি সাত ভাই-বোন রণজিত কুমার রায়ের নামে লিখে দিয়েছেন। যার দলিল নং ৪৩৬৭। দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার টাকা। রণজিত কুমার এখানেও প্রতারণা করে জমির মূল্য কম দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। জমির প্রকৃত মূল্য ১৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। সরেজমিন দেখা যায়, ধান্যকুড়া মৌজার চিত্রা নদের ধারে শ্মশানের অবকাঠামো উন্নয়নকাজ অসম্পন্ন রয়েছে। কোনো রকমে ইটের মেঝেতে চিতা তৈরি করা হয়েছে। উপরে ছাউনি কিংবা কোনো দেওয়াল নেই। পাশে কেনা জমিতেও সবজি চাষ হচ্ছে। ধান্যখোলা গ্রামের পুরোহিত জয়দেব ব্যানার্জি বলেন, শ্মশানের জন্য সাত গ্রামের হিন্দুদের চাঁদার টাকায় ৭৭ শতক জমি কেনা হয়েছে। কিন্তু সেই জমি শ্মশানের নামে রেজিস্ট্রি হয়নি। এমপি রণজিত কুমার রায়ের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে ওই সময় প্রতিবাদ করলেও আমলে নেওয়া হয়নি।শুধু খাজুরা কেন্দ্রীয় শ্মশানের জমি নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বী স্কুল শিক্ষক সুশীল কুমার মল্লিকের প্রায় চার একর জমি লিখে নিয়েছেন সাবেক সংসদ-সদস্য রণজিত। বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সুশীল কুমার মল্লিকের বাড়িতে এক মুসলিম পরিবার বসবাস করছেন। ভিটে জমি তারা কিনেছেন। একই মৌজার প্রায় চার একর বাগান ও ফসলি জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। কিন্তু সুশীল মাস্টারকে জমির টাকা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বছর দুই আগে তিনি মারা যান। তার স্ত্রীকেও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন পলাতক রয়েছেন।সুশীল মল্লিকের ভাতিজা শ্যামল মল্লিক বলেন, তার কাকা হাইস্কুলের শিক্ষক ও কাকিমা স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরি করতেন। দুই সন্তান আগেই ভারতে চলে গেছেন। কাকা একসঙ্গে চার একর জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সাবেক সংসদ-সদস্য রণজিত রায় ওই জমি কিনে নেন। টাকাপয়সা দিয়েছেন কি না জানি না।’এ বিষয়ে বন্দবিলা ইউপি চেয়ারম্যান সবদুল হোসেন খান বলেন, সাবেক সংসদ-সদস্য রণজিত কুমার রায় জোরপূর্বক সুশীল মাস্টারের জমি লিখে নেন। তাকে জমির টাকা দেননি। সুশীল মাস্টারের স্ত্রীকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন। কাকিমা আমার পরিষদে এসেই হাউমাউ করে কান্না করে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।এদিকে বাঘারপাড়ার মথুরাপুর মৌজায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে তিন শতক জমি দেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামে এক যুবক। কিন্তু সেই জমি তৎকালীন সংসদ-সদস্য রণজিত নিজের নামে লিখে নিয়েছেন। মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, আমি আমার জমি ফেরত চাই। বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্মসম্পাদক হাসান আলীকে (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দেওয়ার কথা বলে ৫ বিঘা জমি তার অনুসারীর নামে লিখে নেন রণজিত। নির্বাচনে পরাজিত হন হাসান আলী। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের চাপে পড়ে সেই জমি হাসান আলীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন রণজিত।টিনের বাড়ি থেকে একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক : যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের খাজুরা বাজারটি সমৃদ্ধ জনপদ। এটি এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। একসময় এই বাজারে পানের ব্যবসা করতেন রণজিত কুমার রায়ের বাবা নগেন্দ্রনাথ রায়। পরে লবণের ব্যবসা করেন। খাজুরা বাজারে তাদের একটি পারিবারিক টিনের বাড়ি ছিল। ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচনের আগে থেকেই তারা ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। নবম সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় রণজিত কুমার রায় উল্লেখ করেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল সর্বসাকুল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। এর মধ্যে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক লাখ টাকা মূল্যের চার বিঘা জমি, খাজুরায় চার শতক জমির ওপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর। বার্ষিক আয় ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী নিয়তি রানীর নগদ ৭০ হাজার টাকা, ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। আয়ের কোনো উৎস ছিল না। ১৫ বছর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় রণজিত কুমার রায় দাবি করেছেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি। আর স্ত্রী নিয়তি রানীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি টাকার বেশি। তবে বাস্তবে তারা অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন।সরেজমিন দেখা যায়, যশোর শহরের রেল রোডে রণজিত ও তার স্ত্রী নিয়তি রানীর দুটি বাড়ি রয়েছে। একটি চারতলা। এ বাড়িতে বাস করতেন রণজিত। এ ভবনের এক ভাড়াটিয়া জানালেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের দিনও সংসদ-সদস্য রণজিত রায় বাড়িতে ছিলেন। ওইদিন বিকালে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। তার বাড়ির কেয়ারটেকার ভাড়া আদায় করছেন। এই ভবনটি থেকে কয়েক শ গজ দূরে তিনতলা বাড়িটির মালিক রণজিত রায়ের স্ত্রী নিয়তি রানী। এটিও ভাড়া দেওয়া আছে। নিচতলার এক ভাড়াটিয়া জানান, ৫ আগস্টের পর তাদের এলাকায় দেখা যায়নি। কেয়ারটেকার ভাড়া আদায় করেন। শহরের লোহাপট্টিতে সাত শতক জমির ওপর দুইতলা ভবনের বাড়িটির মালিকও রণজিত রায়। এ বাড়ির নিচে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। ওপরে ভাড়াটিয়ারা বসবাস করেন।জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ যশোর উপবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যশোর শহরের নিউমার্কেট এলাকায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্পে সাড়ে ১২শ স্কয়ার ফুটের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক রণজিত কুমার রায়। বাঘারপাড়া উপজেলা শহরে দুইতলা ও খাজুরা বাজারে তিনতলা বাড়ি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে তার নামে রাজউকের প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে। নির্বাচনি এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেকসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে রণজিত কুমার রায়ের।রণজিত কুমার রায় মূলত ১৫ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে কোটি কেটি টাকা আয় করেছেন। রণজিত, স্ত্রী নিয়তি রানী ও দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তার অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস ছিল টেন্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন গ্রহণ। তার পক্ষে টেন্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন ছেলে বাঘারপাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাজীব রায়, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস ও শ্রমিকনেতা রবিন অধিকারী ব্যাচা এবং বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু।