অনলাইনে বেশি টিকিটে সহজের ‘সহজ লাভ’


ট্রেনের টিকিট বিক্রির অপারেটর সহজ-সিনোসিস-ভিনসেন্ট জেভিকে সহজে ‘বাড়তি আয়ের সুযোগ’ করে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কাউন্টারে বিক্রীত প্রতি টিকিট থেকে ২৫ পয়সা পায় সহজ। অনলাইনে কেনা প্রতি টিকিটে যাত্রী যে ২০ টাকা সেবা খরচ (সার্ভিস চার্জ) দেন, এর সাড়ে ৬ টাকা যায় প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে। ফলে অনলাইনে টিকিট বিক্রি যত বাড়ে, প্রতিষ্ঠানটির তত লাভ। কাউন্টারে টিকিট কমায় যেসব যাত্রী ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে রয়েছেন এবং অনলাইন ব্যবহারে পারদর্শী নন, তাঁরা পড়েছেন বিপাকে। স্টেশনে ঘুরেও টিকিট পাচ্ছেন না। কাউন্টারে টিকিট সংরক্ষণের নিয়ম বা কোটা উঠে যাওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারে পারদর্শীরা ঘরে বসেই সেই টিকিট পাচ্ছেন অনলাইনে। গত ২১ মার্চ রেলভবনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সভাপতিত্বে ঈদ প্রস্তুতি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঈদযাত্রার সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি হবে। আর ১ এপ্রিল থেকে থাকবে না কাউন্টার কোটা। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত তাদের নয়, মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। রেল মন্ত্রণালয় বলছে, কালোবাজারি বন্ধে আজ শুক্রবার থেকে বিক্রি শুরু হতে যাওয়া ঈদযাত্রার ট্রেনের শতভাগ আগাম টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘরে বসেই যাত্রীরা টিকিট নিতে পারবেন। রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, ঈদের পর এসব সিদ্ধান্তের ফল পর্যালোচনা করা হবে। তবে রেল সূত্রের খবর, এই নিয়মই বহাল রাখার পক্ষে মন্ত্রণালয়। পাঁচ বছরে আন্তঃনগর ট্রেনের ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করতে গত বছরের মার্চে সহজের সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। শর্তানুযায়ী, ৮ কোটি টিকিট অনলাইনে বিক্রি হবে। একজন যাত্রী অনলাইনে বা কাউন্টার থেকে একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারেন। অনলাইনে কেনা টিকিটের জন্য দেওয়া বাড়তি ২০ টাকার সাড়ে ৬ টাকা পায় অপারেটর। সাড়ে ৬ টাকা পায় যে ব্যাংকিং গেটওয়ের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করা হয়, সেই প্রতিষ্ঠান। ৩ টাকা ভ্যাট পায় সরকার। বাকি ৪ টাকা রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টের। চুক্তি অনুযায়ী, ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করে মাত্র ৫ কোটি টাকা পাবে সওজ। অনলাইনে ৮ কোটি টিকিট বিক্রি করে পাবে আরও ৫২ কোটি টাকা। আগামী চার বছরে বাকি ১৬ কোটি টিকিটের মধ্যে বাড়তি ৫ কোটি টিকিটও যদি অনলাইনে বিক্রি হয়, অপারেটরের আয় বাড়বে সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি নয়, যাত্রী চাইলে কাউন্টার থেকেও কিনতে পারছেন– রেল এ দাবি করলেও গত বুধবার সরেজমিন কমলাপুর স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, কাউন্টারে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-উত্তরবঙ্গের পথের ১০ দিন পরের শোভন চেয়ার শ্রেণির টিকিটও কাউন্টারে নেই। কাউন্টারে ভিড়ও নেই। শুধু চলতি দিনের ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকজন বুকিং সহকারী (টিকিট বিক্রেতা) জানান, প্রায় সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। কাউন্টারে ১০ শতাংশও বিক্রি হচ্ছে না। তবে ঠিক কত শতাংশ টিকিট কাউন্টার থেকে আর কত শতাংশ অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে, এই হিসাব জানতে পারেনি । রেলওয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, আগামী ১৫ এপ্রিলের ঢাকা-ময়মনসিংহ-তারাকান্দি পথের একটি টিকিটও নেই। অন্য ট্রেনেরও প্রায় একই হাল। আগের নিয়মে যাত্রার পাঁচ দিন আগে টিকিট বিক্রি শুরু হতো। প্রথম ৭২ ঘণ্টার কোটা থাকত, অর্থাৎ কাউন্টারের জন্য সংরক্ষিত টিকিট সেখান থেকেই বিক্রি হতো। ট্রেন ছাড়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে কাউন্টার কোটার টিকিট অনলাইনে কেনা যেত। নতুন নিয়মে ১১ দিন আগে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। কোনো ট্রেনে ৮০০ আসন থাকলে সকাল ৮টায় বিক্রি শুরুর প্রথম মিনিটেই সব টিকিট চাইলে অনলাইনে কেনা সম্ভব। তাহলে কাউন্টারে কেউ টিকিট পাবেন না। অপারেটরের আয় বাড়াতেই এ সিদ্ধান্ত কিনা– এ প্রশ্নে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ৮ কোটি টিকিট অনলাইনে বিক্রির চুক্তি হয়েছে। এত টিকিট তো এক বছরে বিক্রি হয়নি। তাই অপারেটরের বাড়তি টাকা পাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে না। ৮ কোটির বেশি টিকিট অনলাইনে বিক্রি হলে পর্যালোচনা করা হবে। প্রতি টিকিটে ২০ টাকা সেবা খরচ যৌক্তিক কিনা– প্রশ্নে সচিব বলেন, এ নিয়ম আগে থেকেই রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ১৫ বছর ট্রেনের টিকিট বিক্রি করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি টিকিটে ২ টাকা ৯৯ পয়সা নিত। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জিয়াউল হাসান সারোয়ার বলেন, সিএনএস প্রথম দিকে মাত্র ২০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করত। অনলাইনে যত শতাংশ টিকিট বিক্রি হোক না কেন, অপারেটরের খরচ একই। এখন অনলাইনে টিকিট সংখ্যা বাড়ায় প্রতি টিকিটে ১০ টাকার কম সেবা খরচ হওয়া উচিত। অপারেটর নিয়োগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলওয়ের আহ্বান করা দরপত্রে প্রতিটি টিকিট বিক্রির জন্য ৪ টাকা ৩৫ পয়সা চার্জ প্রাক্কলন করা হয়। সহজ ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করে দিতে ৩০ কোটি ২৫ লাখ এবং সিএনএস ২৪ কোটি টাকা প্রস্তাব করে। সহজের প্রস্তাব ছিল, তারা রেলের কাছ থেকে ৫ কোটি এবং বাকি টাকা বিজ্ঞাপন থেকে আয় করবে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এ যুক্তিতে সহজকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত করে। সিএনএস এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেন্টাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ করে। রায়ে বলা হয়, চাতুর্যপূর্ণ দরপত্রে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা প্রাক্কলন ছিল অতিমূল্যায়িত। সহজের রিটে সিপিটিইউর রায় হাইকোর্ট স্থগিত করেন। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পায় প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র বলছে, রেল মন্ত্রণালয় আগ্রহী ছিল সহজকে কাজ দিতে। অনলাইনে টিকিট বিক্রি বাড়ায় রেলওয়েতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এক কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশে হাজারখানেক কাউন্টারে রেলের বিপুল জনবল রয়েছে। কাউন্টারে টিকিট বিক্রি না হলে তারা কী করবে? এ প্রসঙ্গে রেল সচিরের ভাষ্য, ১৫২টি লোকাল ও মেইল ট্রেন চলছে। সেগুলোর শতভাগ টিকিট কাউন্টার থেকে দেওয়া হচ্ছে। ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ নীতি বাস্তবায়নে গত ১ মার্চ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে আগাম নিবন্ধন করে টিকিট কিনতে হচ্ছে যাত্রীদের। একে কালোবাজারি বন্ধের ‘মহৌষধ’ বলছে মন্ত্রণালয়। বুধবার কমলাপুর ঘুরে দেখা গেছে, এ পদ্ধতির জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহারে অনভিজ্ঞরা ভুগলেও কালোবাজারি থামেনি। কালোবাজারির সদস্যরা অনলাইন থেকে টিকিট কিনে তা আবার কাউন্টারে ফেরত দিচ্ছে। এতে কিছু টাকা যাচ্ছে। তবে বাড়তি দামে ওই ফিরতি টিকিট যাত্রী কিনছেন কাউন্টার থেকে। এ ব্যাপারে রেল সচিব বলেন, এ অভিযোগ প্রতিকারে কাজ চলছে। নতুন নিয়মে সহযাত্রীর এনআইডি নম্বর দিতে হচ্ছে একাধিক টিকিট কিনলে। রেলের ঘোষণা ছিল, টিকিটে যাঁরা নাম রয়েছে, তিনিই ভ্রমণ করতে পারবেন। অন্যথা বিনা টিকিটের যাত্রী গণ্য করে জরিমানা করা হবে। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য ছবি ও ভিডিও এসেছে যাতে দেখা যাচ্ছে, রেলের কর্মীরা প্রকৃত টিকিটধারী যাত্রী কিনা, সেই পরীক্ষা দূরে থাক, উল্টো টাকা নিয়ে ট্রেনে যাত্রী তুলছেন। কমলাপুরে ঢাকা-গফরগাঁও পথের যাত্রী মো. ফজলু মিয়া বুধবার জানান, এনআইডি এসএমএস করে নিবন্ধন করেছেন। তবে তাঁর কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোন নেই। দু’দিন ঘুরেও কাউন্টারে টিকিট পাচ্ছেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলে, অনলাইনে বিক্রি হয়ে যায়। কাউন্টারে টিকিট না পাওয়া ফজলু মিয়ার মতো প্রান্তিক মানুষের ভোগান্তি সম্পর্কে রেল সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, লোকাল ও মেইল ট্রেন তো আছে। সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে সহজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মালিহা এম কাদিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে । তবে সহজ কর্তৃপক্ষ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।