অভিযোগ নেয় না হটলাইন, অচল ওয়েবসাইট


উদ্বোধনের তিন বছর পরও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়নি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ‘ভোক্তা হটলাইন-১৬১২১’। কিন্তু এ নম্বরে কল করে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলেও অপর প্রান্তে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কখনো সাড়া পাওয়া গেলেও কাজের কাজ কিছু হয় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ শোনার পর বলা হয় ভোক্তা অধিকার অফিসে এসে ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হবে। অর্থাৎ ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোক্তাদের অ্যানালগ সিস্টেমে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে ঘরে বসে অভিযোগ দেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেস (সিসিএমএস) ওয়েবসাইট থাকলেও তা নিষ্ক্রিয়। এ সংক্রান্ত অপশনে গেলে লেখা আসে সার্ভার মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে। এর ফলে অভিযোগ আমলে নেওয়া সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি সেবা খাতা-কলমে থাকলেও কার্যত বাস্তবে নেই। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভোক্তাদের কাছ থেকে অভিযোগ নেওয়ার এ দুটি মাধ্যম এক সময় অনেক জনপ্রিয় হবে। তবে এখন মাধ্যম দুটি ভালোভাবে সক্রিয় করতে কাজ চলছে।’ তিনি মনে করেন, অভিযোগ জানানোর এ দুটি মাধ্যম ভবিষ্যতে জনপ্রিয় হটলাইন নম্বর হবে। এটার মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে ভোক্তার আরও কাছে যেতে পারব। প্রধানমন্ত্রী যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন সেখানে ভোক্তার অধিকার সুরক্ষায় যা যা করণীয় তা নিশ্চয় আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন সেবা চালু হওয়ার পর মানুষের যেন অভিযোগের অন্ত নেই। তবে যতটা অভিযোগ পণ্য কিংবা সেবা নিয়ে, তার চেয়ে বেশি অভিযোগ এই হটলাইন নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, এটা এখন হটলাইন না হয়ে কোল্ডলাইন হয়ে গেছে। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বলেন, পুরোপুরি কার্যকর না করে শুধু বাহাবা নেওয়ার জন্য চালু করে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করার আগে নিজেরা ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হতো। এদিকে পক্ষ থেকে গত তিন দিনে একাধিকবার হটলাইনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাত্র একবার ছাড়া আর সাড়া পাওয়া যায়নি। যখন পাওয়া যায়, তখন তিনি অভিযোগ শুনে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না করে অফিসে এসে ফরম পূরণ করে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনো ভোক্তা যখন অভিযোগ জানাতে ফোন করবেন তখন তার তো এ ধরনের পরামর্শ শোনার ধৈর্য থাকবে না কেসস্টাডি : পণ্য কিনে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ জানাতে রোববার রাত ৯টা ৭ মিনিটে ভোক্তা হটলাইনে ফোন করেন জনৈক ইকবাল হাসান ফরিদ। কিন্তু তার ফোনকল কেউ রিসিভ করেনি। এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী জানান, ‘একটি পণ্য কিনে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য ভোক্তা হটলাইনে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ৫ মিনিট ২৪ সেকেন্ড হলেও তারা কল রিসিভ করেনি। এটাও একটা প্রতারণা। কারণ পত্রিকার নিউজে জানতে পেরেছিলাম পণ্য কিনে ঠকলে ভোক্তা অধিদপ্তর হটলাইনে ফোন করে অভিযোগ দেওয়া যাবে। কিন্তু হটলাইনে অভিযোগ দিতে পারলাম না।’ কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা শান্তা জানান, ‘ভোক্তা হটলাইনে ফোন করে অভিযোগ দায়ের করতে চেয়েছিলাম। ফোনও করেছিলাম। কিন্তু তারা আমার ফোন রিসিভ করলেও অভিযোগ নেয়নি। কীভাবে অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে হবে সে বিষযে পরামর্শ দিয়েছেন। এটা কোনো কথা হলো? আমি যদি প্রতারিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিকার না পাই তাহলে এই হটলাইনের কি দরকার। এটা এক ধরনের ছলচাতুরী।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘ভোক্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে ভোক্তা অধিদপ্তর ভোক্তা হটলাইন চালু করেছে। পাশাপাশি অভিযোগ দায়ের করতে এ বছর সিসিএমএস ওয়েবসাইটও চালু করেছে। কিন্তু কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এই ডিজিটাল যুগে এখনো অ্যানালগ সিস্টেমে ভোক্তাকে অধিদপ্তরে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’ তিনি জানান, ভোক্তার সুরক্ষায় ২০০৯ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে পণ্য বা সেবা উৎপাদন, ক্রয়, বিক্রয়ে অনিয়ম করলে জরিমানাসহ জেলে পাঠানোর বিধান আছে। কিন্তু সে আইন এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর নয়। বড় বড় সিন্ডিকেট হাতেনাতে ধরলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করছে না। বরং ছোট ব্যবসায়ীদের নামমাত্র জরিমানা করে দায় সারছে। রোববার অভিযোগ দায়ের করার কার্যক্রম দেখতে সিসিএমএস ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন এই প্রতিবেদক। এতে প্রথম ক্লিক করলে প্রথম পেজে অভিযোগের ধরন নির্বাচন করতে দুটি অপশন দেওয়া হয়। একটি সাধারণ অভিযোগ, আরেকটি ই-কমার্স সংক্রান্ত অভিযোগ। এরপর সাধারণ অভিযোগ অপশনে ক্লিক করতেই পেইজটি আর কাজ করে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্ক্রিনে একটি মেসেস আসে। যেখানে লেখা আছে ‘সার্ভার মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। মেইনটেন্যান্স কার্যক্রম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্ভার চালু হবে।’ প্রসঙ্গত, ভোক্তাকে সেবা দিতে হাইকোর্ট ২০১৯ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে হটলাইন চালু করার নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে হটলাইন সেবা চালু করা হয়। যার নম্বর ১৬১২১। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আনুষ্ঠানিকভাবে এই হটলাইন চালু করেন। কিন্তু উদ্বোধনের তিন বছর পার হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি ভোক্তার অভিযোগ দায়ের আরও সহজ করতে গত ১৫ মার্চ সিসিএমএস ওয়েবসাইট উদ্বোধন করা হয়। তবে এই ওয়েবসাইট এখনো নিষ্ক্রিয়। এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান আরও বলেন, হটলাইনে ভোক্তা কীভাবে মামলা করবে এখন শুধু এমন তথ্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা এখনো সরাসরি অভিযোগ-পরবর্তী তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারিনি। অপরদিকে সিসিএমএস চালু হলেও পাইলোটিং করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটা যাতে হটলাইন ১৬১২১-এর সঙ্গে লিংক করা যায় সেজন্য কাজ করছি। অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছি। জনবল সংকটে হটলাইন পূর্ণাঙ্গ চালু করতে না পারলেও মামলা কীভাবে করতে হবে তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কেউ মামলা করলে তা কোন পর্যায়ে আছে সেটি জানানো হচ্ছে। এছাড়া কিছু কারণে সিসিএমএস ওয়েবসাইট রোববার নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে তা ইতোমধ্যে সমাধান করা হয়েছে। ভোক্তারা অভিযোগ করতে পারছেন। এদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সোমবার রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে সিসিএমএস ওয়েবসাইট সক্রিয় পাওয়া যায়নি। আগের মতো একই মেসেস ভেসে ওঠে।