
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ জোরশোরে এগিয়ে আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর সীমানা পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত আইন সম্প্রতি সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই অধ্যাদেশ জারির পরে এ কাজে গতি ফিরেছে। আগামী নির্বাচনে ৩০০টি আসনই বহাল থাকবে এবং বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে সীমানা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে ইসি। রাজনৈতিক ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত না আসায় এই মুহূর্তে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে সীমানা পরিবর্তনের দাবিতে ইসিতে জমা হওয়া আবেদন, সর্বশেষ প্রকাশিত জনশুমারি এবং প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (১৯ মে) পর্যন্ত ৬৬টি আসনে ৪১৬টি আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনকারীদের বেশিরভাগই বিএনপির নেতাকর্মী। রয়েছেন দলটির বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ-সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি। তাদের অন্তত ৯০ ভাগই ২০০১ সালের সীমানায় ফেরার দাবি জানিয়েছেন। ইসির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, জমা হওয়া ‘যৌক্তিক আবেদন’ বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। ওই কারণে এবার অনেক আসনের সীমানায় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। শহর এলাকার আসন কমে যেতে পারে। বাড়তে পারে গ্রামের আসন। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।আরও জানা গেছে, সীমানা পরিবর্তন চেয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ আসনে। এই আসনে আবেদন পড়েছে অন্তত ১০৩টি। আর কুমিল্লা-১০ আসনে জমা হয়েছে অন্তত ৯২টি। ঢাকা-৭ আসনে আবেদন পড়েছে ৩৬টি এবং ঢাকা-১, ২ ও ৩ আসনে পড়েছে ২৩টি। মানিকগঞ্জে একটি আসন বাড়ানোর দাবিতে আবেদন পড়েছে ৩৮টি। আর চাঁদপুরে একটি আসন বাড়ানোর জন্য ৯টি আবেদন জমা হয়েছে। সব আবেদনই যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ও সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, যারা আবেদন করেছেন, তাদের যুক্তিগুলো আমরা দেখছি। তাদের আবেদনের যৌক্তিক বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য নেই। ২০০১ সালের সীমানায় ইসি ফিরবে কীনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা আবেদন করেছেন, তাদের যুক্তি সঠিক হলে, সেটা দেখব। তবে সব আসনেই সীমানায় রদবদল হবে বিষয়টি তেমন নয়। অনেক আসন রয়েছে, যেগুলো বিদ্যমান সীমানাই যৌক্তিক।ইসিসংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সময়ে সাধারণত ইসি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া তালিকা প্রকাশ করত। ওই খসড়া তালিকার ওপর দাবি, আপত্তি বা অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় দিত। এরপর দাবি, আপত্তি বা অভিযোগ বিচার-বিশ্লেষণ ও শুনানি করে আসন চূড়ান্ত করত। বর্তমান এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ইসিতে জমা হওয়া আবেদন গুরুত্ব দিচ্ছে। ওই সব আবেদনের সারসংক্ষেপ তৈরি করে তা বিশ্লেষণ করছে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব আবেদন বিবেচনা করা হচ্ছে। ওই আবেদন বিবেচনা করতে গিয়ে একটি আসনের সীমানায় রদবদল করার প্রভাবে আরও অন্তত এক বা একাধিক আসনেও পরিবর্তন আসবে। এই কারণে ২০০৮ সালের পর এবার সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।জানা যায়, ১৯৯১ সালের পর ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় পরিবর্তন হয়েছিল। ওই সময়ে শতাধিক আসনের সীমানায় পরিবর্তন হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। বিএনপি মনে করে, দলটিকে হারিয়ে দিতে সূক্ষ্ম কারচুপির অংশ হিসাবে তখন আসন সীমানা পরিবর্তন করা হয়েছিল। এরপর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় ধরনের পরিবর্তন করেনি তৎকালীন নির্বাচন কমিশনগুলো। ২০১৩ সালে ৫০টি, ২০১৮ সালে ২৫টি ও ২০২৪ সালে এক ডজন আসনে সামান্য রদবদল করেছিল। এমনকি সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত আইনের ৮ ধারায় এক সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পথ রুদ্ধ করে দেয়। সম্প্রতি ওই আইনের ওই ধারা সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।আরও জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম সভায় ২০০১ সালের আসন সীমানায় ফেরার ইঙ্গিত দেন। ওই সভায় ২০০১, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে কোন আসনে কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তার তুলনামূলক বিবরণীও তৈরির নির্দেশনা দেন। এছাড়া কমিশন জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যার সামঞ্জস্য রাখার কথা চিন্তা করে আইন সংশোধনী প্রস্তাব করেছিল। যদিও সরকার ওই সংক্রান্ত ধারায় সংশোধনী আনেনি।আবেদনের হিড়িক : প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (১৯ মে) পর্যন্ত ৬৬টি আসনে ৪১৬টি আবদেন জমা পড়ছে। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সংসদীয় আসনে পরিবর্তন চেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ ইসিতে এসে যোগাযোগও করছেন।সীমানা পরিবর্তন চেয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ আসনে। এই আসনে অন্তত ১০৩টি আবেদন জমা পড়েছে। বেশিরভাগ আবেদনে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের মতো কাউখালী ও ভাণ্ডারিয়া উপজেলা অথবা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ন্যায় কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও ইন্দুরকানী উপজেলা নিয়ে এ আসনের সীমানা নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে পিরোজপুর-২ আসন রয়েছে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, পিরোজপুর-২ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হলে এর প্রভাবে পিরোজপুর-১ আসনেও পরিবর্তন আসবে। এই আসনে বেশ কয়েকবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টি (জেপি) প্রধান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মহারাজের কাছে হেরে যান তিনি। এছাড়া পিরোজপুর-১ আসনের সংসদীয় এলাকার সীমানা পরিবর্তন চেয়ে একটি আবেদন জমা হয়েছে।ঢাকা-১, ২ ও ৩ এই তিনটি আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ২৩টি। এর মধ্যে বেশিরভাগই আবেদনে দোহার উপজেলাকে ঢাকা-১ এবং নবাবগঞ্জ উপজেলাকে ঢাকা-২ আসনে পুনর্বহাল করার দাবি করা হয়েছে। ২০০১ সাল ও তার আগেও এই দুটি উপজেলা আলাদা সংসদীয় আসন ছিল। এই দাবির সপক্ষে যারা আবেদন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-দোহার ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলুল হক, দোহার পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা আব্দুর রহিম মিয়া, বিএনপি নেতা মো. সালাউদ্দিন মোল্লা, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) কেন্দ্রীয় যুগ্ম-আহ্বায়ক কেএম খালেকুজ্জামান ও দোহার-নবাবগঞ্জ আসন পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক মো. হুমায়ুন কবীর প্রমুখ।এ বিষয়ে কেএম খালেকুজ্জামান বলেন, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিটিশ আমল থেকে দোহার ও নবাবগঞ্জ আলাদা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধার্থে ২০০৮ সালে সারা দেশে যেসব আসন ভাগ করা হয়, তার মধ্যে এটি একটি। তিনি বলেন, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলা নিয়ে একটি আসন হওয়ায় দুই উপজেলাতে সরকারি বরাদ্দ কমেছে। আসন পৃথক হলে দুই উপজেলায় বরাদ্দ বাড়বে, উন্নয়নও বেশি হবে।ঢাকা-৭ আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে ৩৬টি আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনকারীদের বড় অংশ ঢাকা-২ আসন পুনর্নির্ধারণ করে কামারাঙ্গীরচর থানাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫, ৫৬, ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-৭ লালবাগ এলাকার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করেছেন। বর্তমানে জিনজিরা, আগানগর, তেঘরিয়া, কেন্ডা ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন বাদে কেরানীগঞ্জ উপজেলা, সাভারের আমিনবাজার, তেঁতুলঝরা ও ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-২ আসন।এছাড়া ঢাকা-৪ আসনে ২টি, ঢাকা-১২ আসনে একটি, ঢাকা-১৬ আসনে একটি, ঢাকা-১৯ আসনে একটি এবং ঢাকা-২০ আসনে একটি করে আবেদন রয়েছে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ সালে ঢাকায় আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। এ কারণে কয়েকটি জেলার আসন কমেছে। এবার ইসি শহরের আসন কমাতে চায়।কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৯, ১০ সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে মোট ১০৪টি আবেদন জমা হয়েছে। এসব আবেদনে যেসব পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে এ জেলার অন্য কয়েকটি আসনের সীমানাতেও পরিবর্তন আসবে।এই জেলার যারা আবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কুমিল্লা-৯ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ-সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, সাবেক সংসদ-সদস্য মো. আবদুল গফুর ভূঁইয়া প্রমুখ। সংসদীয় আসনের সীমানায় সংশোধনের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বর্তমান সিটি করপোরেশনের ১৯ থেকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড লালমাই উপজেলা, সদর দক্ষিণ উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-৯ আসন ছিল। এই আসন নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ জেতাতে এ আসনের সীমানায় পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমি এই নির্বাচনি এলাকা ২০০১ সালের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। তিনি বলেন, শুধু এই আসন নয়, তিনশ আসনই ২০০১ সালে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছি।মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা থেকে অর্ধশতাধিক আবেদন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এসব আবেদনে ওই চার জেলায় একটি করে আসন বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। এসব আবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের সীমানা নির্ধারণের সময়ে এসব জেলার একটি করে আসন কমানো হয়েছে। তারা ওইসব আসন পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। ইসির কর্মকর্তারা জানান, ওইসব জেলায় একটি করে আসন যুক্ত করা হলে বিদ্যমান সবকটি আসনের সীমানায় পরিবর্তন আসবে।অন্য জেলাগুলোর মধ্যে বরিশাল-৪ সংসদীয় আসন থেকে হিজলা উপজেলাকে কর্তন করে বরিশাল-৩ আসনের সঙ্গে যুক্তের জন্য একটি আবেদন পড়েছে। এছাড়া রংপুর-১ আসনে একটি, গাইবান্ধা-৩ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে দুটি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে তিনটি ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে ৫টি আবেদন রয়েছে। যশোর-২ আসনে একটি, সাতক্ষীরা-৩ আসনে একটি সাতক্ষীরা-৪ আসনে একটি, বরগুনা-১ ও ২ আসনে ৮টি, ঝালকাঠী-২ আসনে একটি, নেত্রকোনা-৫ আসনে একটি, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে একটি, গাজীপুর-১ আসনে একটি, গাজীপুর-৩ আসনে পাঁচটি, গাজীপুর-৫ আসনে চারটি আবেদন রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি আসনের সীমানা পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে।
