ইতিহাসের সাক্ষী খাসনগর দীঘি
অনলাইন নিউজ ডেক্স
মসলিনের গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী সোনারগাঁয়ের খাসনগর দীঘি। এক সময় এর চারপাশ ঘিরে বিশ্বখ্যাত মসলিন বুনন শিল্পী আর তাদের পরিবারের সদস্যদের বসতিস্থল ছিল। প্রায় ৫০ বিঘা আয়তনের এ সুবিশাল দীঘির চারপাশ এখন তাদের চিহ্নটুকুও নেই। সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পাশে দক্ষিণে প্রায় ২শ গজ দূরে খাসনগর গ্রামের সন্নিকটে প্রধান সড়কের পাশেই প্রাচীন এ দীঘির অবস্থান।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনামতে, এক সময় এই দীঘির পাড়ে বিখ্যাত ঢাকাই মসলিন তাঁতিদের বসতি ছিল। ঢাকাই মসলিন উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁ। মসলিনের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও উন্নত ধরনের বস্ত্রের নাম ছিল ‘খাস’। ধারণা করা হয়, সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র খাস থেকেই সম্ভবত খাসনগর গ্রাম ও খাসনগর দীঘির নামকরণ করা হয়েছে। আর এ সূত্রেই কারও কারও অনুমান, এক সময় এই খাসনগর ছিল সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও উন্নতমানের মসলিন বস্ত্র ‘খাস’ উৎপাদনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারের পণ্ডিত আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সোনারগাঁর এক বিশাল দীঘির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর পানিতে ধোয়া বস্ত্র এক ধরনের বিশেষ শুভ্রতা পেত। এতে প্রায় নিশ্চিতভাবেই খাসনগর দীঘিকে উল্লেখ করা হয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।
অপরূপ প্রাকৃতিক শোভার এ দীঘির পানি সারা বছরই টলটলে পরিষ্কার থাকে। আশপাশের পরিবেশও স্নিগ্ধ ও ছায়া সুনিবিড়। দীঘিকে ঘিরে এর পূর্ব পাড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক পিকনিক স্পট। এ কারণে সারা বছরই দীঘির পূর্ব পাড়ে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে।
ঐতিহাসিকদের মতে, হাতের আংটির ভেতর দিয়ে এক কোনা ধরে পুরো শাড়ি টেনে বের করা বা আস্ত বস্ত্রটি দেশলাইয়ের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা এমন কথার সমার্থক হয়ে আছে সোনারগাঁয়ের মসলিন। অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে জগৎজুড়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এ মসলিন। মোগল রাজদরবারে মসলিনের ব্যাপক সমাদর ছিল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই মসলিন। বর্তমানে এটাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে একাধিক গবেষক দল। ঢাকার মসলিন খুব সূক্ষ্ম মিহি ও মোলায়েম ছিল। এই মসলিনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সোনারগাঁয়ের নাম। এখানকার মসলিনের কারুকার্য বিশ্বজুড়ে যুগের পর যুগ প্রশংসিত হয়েছে। এখন আর সোনারগাঁয়ে সেই মসলিন নেই। নেই সেই তাঁতিরাও। এখন নেই খাসনগর দীঘির চারপাশে গড়ে উঠেছে লোহা ও গুণার জাল বুননের কারখানা।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী থেকে জানা যায়, সুবেদার ইসলাম খাঁন সোনারগাঁয়ে তৈরি বিশেষ মসলিন কাপড় বাদশাহর দরবারে পাঠাতেন। তাতে লেখা থাকত ‘খাসনগর’। খাসনগর লেখা না থাকলে রাজদরবারে মসলিন গ্রহণ করা হতো না। মূলত মসলিনের সর্বাধিক কদর ছিল মোগল আমলেই। তখন মসলিনের খ্যাতি এশিয়া ছাড়িয়ে অন্যান্য মহাদেশেও সমাদৃত হয়েছিল।
সোনারগাঁয়ের খাসনগরসহ আশপাশের শতাধিক দীঘির স্বচ্ছ পানি ও ঠান্ডা বাতাস মসলিন ধুয়ে শুকানোর বিশেষ উপযোগী ছিল। প্রাচীনকালে বাংলা ভ্রমণে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের নজর কেড়ে নিয়েছিল মসলিনের বিশেষ বুনন ও নিখুঁত কাপড়।
চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলায় এসেছিলেন মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি মসলিনে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এমন উন্নতমানের বস্ত্র হয়তো সারা দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। মসলিন তৈরি হতো ‘ফুটি কার্পাস’ নামক গাছের তুলা থেকে। এটি অন্য জাতের তুলা থেকে অনেকটা ভিন্ন। দেশের কয়েকটি স্থানে এ তুলা পাওয়া যেত।
খাসনগর দীঘিটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মিলে প্রায় ১৩.৪৪ একর জমির ওপরে। সোনারগাঁয়ে গৌরবের এ সুবিশাল দীঘি বর্তমানে পলিমাটিতে ভরে আছে। এখন এর গভীরতা নেই বললেই চলে।
কথিত আছে, দীঘিটি খননকালে প্রায় বিশ একর জমির ওপর বিস্তৃত ছিল। পরবর্তী সময়ে জেমস ওয়াইজ (১৮৭২) দীঘিটির আয়তন নিরূপণ করতে গিয়ে এটিকে ৯.৭৫ একর ভূমির ওপর বিস্তৃত বলে মন্তব্য করেছেন। পক্ষান্তরে আলেকজান্ডার কার্নিংহাম (১৮৭৯-১৮৮০) এর পরিমাপ উল্লেখ করেছেন দৈর্ঘ্যে ১২০০ ফুট এবং প্রস্থে ৬০০ ফুট। জেমস টেলর বিখ্যাত তার মন্তব্যে খাসনগর দীঘিকে মসলিন তৈরির অন্যতম স্থান বলে উল্লেখ করেছেন। টেলর খাসনগর দীঘির তীরে ৬০ জনের মতো মসলিন তাঁতির বসতি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন।
জেমস টেলর ছিলেন তৎকালীন ঢাকার কালেক্টর। তিনি একটি বইতে লিখেছেন ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’। সেখানে তিনি লিখেছেন-সে সময়ে সোনারগাঁয়ের মসলিন অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের ছিল। তিনি পানাম নগরকে মসলিন ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করেন। তখন খাসনগর দীঘির পাড়ে মসলিন তাঁতিরা সুতো কাটতেন।
জেমস টেলর উল্লেখ করেন-তিনি স্বচক্ষে খাসনগর দীঘি অবলোকন করেছেন। সে সময় পানাম নগরী মসলিনশিল্পের বিখ্যাত কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। বিদেশি বণিকরা মসলিন কাপড় ক্রয় করার জন্য পানাম নগরে এসে ভিড় করতেন। কথিত আছে, ঝিনুকের খোলের ভেতর শত শত গজ মসলিন কাপড় ঢুকিয়ে তা বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হতো। ১৭৫ গজ মসলিন কাপড় একত্রিত করলে একটি কবুতরের ডিমের মতো হতো। ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, কিভাবে কারিগররা এত সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করতেন!!! মসলিন তৈরি করতে তাঁতিদেরও কম কষ্ট করতে হতো না। সাধারণত একটি মসলিন কাপড় ২০ গজ লম্বা ও ১ গজ চওড়া হতো। ভেজা জলবায়ুতে মসলিনের সুতা কাটা হতো। শুকনো বায়ুতে মসলিনের সুতা কাটা সম্ভব ছিল না।
জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে খাসনগর দীঘির গুরুত্ব অনেক। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মসলিনের ইতিকথা। সেজন্যই সর্বস্তরে দাবি উঠেছে দীঘিটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের।
