পৃথিবীতে অনেক সময় জুলুম ও অনাচারের সম্মুখীন হতে হয়। যখন কেউ অত্যাচার করে তখন কেউ সহ্য করে, কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে, কেউ ক্ষমা করে আবার কেউ পাল্টা জুলুম করে। অত্যাচারের প্রতিশোধের সুযোগ থাকলেও ইসলামে প্রতিশোধ ত্যাগ করে ক্ষমা করলে আলাদা মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করতে পারা অনেক বড় মানবিক গুণ। জীবনে চলার পথে অনেকের আচরণে বা উচ্চারণে আঘাত আসতে পারে। প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমার শক্তি অর্জন করা মুসলমানের সঞ্চয়। এতে পরকালে যেমন মিলবে বিশাল প্রতিদান, দুনিয়ায়ও আসবে শান্তি, স্থিতি ও সম্মান। আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় রাসুলকে (সা.) ক্ষমাশীল হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে বলেন—‘হে নবী! আপনি ক্ষমা করুন। সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন।’ (সুরা আরাফ: ১৯৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘অতএব আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)।
প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা করা আল্লাহভিরু মুমিনের বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহভিরু তারাই, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল হয়। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৪)। পৃথিবীতে যে মানুষ যত বেশি মহৎ, সে তত বেশি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করলে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (মুসলিম: ২৫৮৮)। নবী করিম (সা.)-কে তায়েফবাসী পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করার পর আল্লাহতায়ালা পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাকে পাঠান। ফেরেশতা তায়েফবাসীকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেননি, বরং তাদের ক্ষমা করে তাদের জন্য এভাবে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! তারা অজ্ঞ, তাই তারা আমার ওপর জুলুম করেছে। তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং হেদায়াত নসিব করো।’ (ইবনে হিব্বান: ৯৭৩)। বিশ্বনবীর সহধর্মিণী আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) অশ্লীলভাষী ছিলেন না এবং অশোভন কথা বলার চেষ্টাও করতেন না। তিনি হাট-বাজারে শোরগোলকারী ছিলেন না এবং তিনি মন্দের প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা নিতেন না বরং তা ক্ষমা করে দিতেন এবং উপেক্ষা করে চলতেন।’ (মেশকাত: ৫৪৪৮)।
ইসলামে মিথ্যাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সব পাপের মূল, ঘোষণা করা হয়েছে মিথ্যাবাদী মুসলমান হতে পারে না এবং মিথ্যাবাদীর জন্য জাহান্নামের শাস্তি। এতদ্বসত্ত্বেও ইসলামে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়ার স্বার্থে মিথ্যা কথা বলা জায়েজ করা হয়েছে। কেননা, মিথ্যা কথা বলেও যদি পরস্পরবিরোধী দুপক্ষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখা যায়, তবুও সেটা হবে কল্যাণকর। এ সম্পর্কে উম্মে কুলসুম (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কল্যাণ স্থাপনের উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে যে ব্যক্তি পরস্পরবিরোধী দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, সে কখনোই মিথ্যাবাদী নয়। সে কল্যাণই বৃদ্ধি করে অথবা সে কল্যাণের কথাই বলে।’ (বুখারি: ২৬৯২; মুসলিম: ৬৫২৭)
সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমরা রাসুল (সা.)-এর জীবনী থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা যদি রাসুল (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে দেখতে পাব কাফেরদের সঙ্গে সাময়িক সময়ের জন্য সমঝোতা করার ফলে ইসলামে পরবর্তীকালে সুবিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল সাড়ে চৌদ্দশ। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে পরবর্তীকালে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজার পরিমাণ। সেদিন কাফেরদের সঙ্গে সন্ধির পরিবর্তে যুদ্ধ হলে হয়তোবা এমন সুবিজয় নিশ্চিত হতো না। কেননা, যুদ্ধবিগ্রহ ডেকে আনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। পক্ষান্তরে একে অন্যের প্রতি সমঝোতা ও সন্ধি ডেকে আনে শান্তি ও শৃঙ্খলা। বিশ্বনবী (সা.) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে সংঘর্ষ পরিহার করে শান্ত ও সহাবস্থানের স্বার্থেই মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে নিজেদের পক্ষের সুবিধা ত্যাগ করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। যুদ্ধবাজ কুরাইশদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধবিগ্রহের কারণে গোটা আরব সমাজে হত্যা, সন্ত্রাস, লুণ্ঠনসহ নানারূপ গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে নিরিখে প্রজ্বলিত দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছিল—আল্লাহর রাসুল (সা.) এ নরকতুল্য পরিস্থিতি থেকে সমাজকে মুক্তিদানের জন্য অধীর প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলেন। হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তিতে যেসব বিষয় লেখা ছিল, তা হলো উভয়পক্ষ এ ব্যাপারে একমত হচ্ছে যে, দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই দশ বছর জনগণ পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সব রকমের আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম)। চুক্তির পরবর্তী উল্লেখ করা হলো, কুরাইশদের কোনো লোক মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে গেলে তাকে ফেরত দিতে হবে কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দল থেকে কেউ মক্কার কুরাইশদের কাছে পৌঁছলে কুরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। বাহ্যত এ অবমাননাকর সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে মুসলিম শিবিরের অনেকেই ঘোর আপত্তি উত্থাপন করতে শুরু করলেন, এমনকি বিশিষ্ট সাহাবিদের মধ্য থেকেও বিরোধিতার আওয়াজ উঠতে শুরু করল। মহানবী (সা.) আল্লাহতায়ালার সরাসরি ইঙ্গিতে শান্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের বৃহত্তর স্বার্থে সন্ধি স্থাপনের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সন্ধিচুক্তির ধারাগুলো অনুমোদন করলেন। মহানবী (সা.)-এর এ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহ ‘ফাতহুম মুবিন’ অর্থাৎ, সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে ঘোষণা করে কোরআনে আয়াত নাজিল করলেন।
ইসলামের ইতিহাসে মক্কা বিজয় একটি অসাধারণ ঘটনা। নীরব রক্তপাতহীন এক জয়ের নাম মক্কা বিজয়। এটি এমন ঘটনা, যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা ইসলাম ও তার রাসুলকে শক্তিশালী করেছেন। এ বিজয়ে আসমানের অধিবাসীরা খুশি হয়েছিল এবং দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে। অষ্টম হিজরির রমজান মাসে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ বা ১৩ জানুয়ারি মক্কা বিজয় হয়। নবী (স.) দশ হাজার মুজাহিদের একটি বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশে বের হন। মুসলিম বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিনা বাধায় মক্কা জয় করলেন। এ বিজয় সূচিত হয়েছিল কোনো রক্তপাত ছাড়াই। প্রথমে তিনি কাবাঘরের দিকে গেলেন। তার চারপাশে আনসার ও মুহাজিররা ঘিরে ছিল। কাবায় গিয়ে তিনি আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করলেন। তারপর নবী (সা.) কাবার ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং আট রাকাত নামাজ পড়লেন। সেদিন মক্কার অধিবাসীরা ভয়ে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। ইসলামের মূলোৎপাটনে যারা নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছিল, অশ্লীল ভাষায় মহানবী (স.)-কে অজস্র গালাগাল করত, বিষাক্ত বর্শা হাতে তাকে হত্যা করতে ওতপেতে থাকত, তার দেহ মোবারক থেকে রক্ত ঝরাত, নামাজে নাড়িভুঁড়ি চাপা দিত, মাতৃভূমি ত্যাগ করতে যারা বাধ্য করেছিল, আজ তারা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দলে দলে কাবা প্রাঙ্গণে সমবেত হলো। আজ তাদের সেই দর্প, গর্ব ও আস্ফালন নেই। দশ হাজার মুসলিম বাহিনী দ্বারা বেষ্টিত আজ তারা শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে দুরুদুরু বুকে চেয়ে আছে দয়ার সাগর মহানবী (স.)-এর ফয়সালার দিকে।
নামাজ শেষে কাবার ভেতর থেকে বাইরে আসলেন নবীজি। কুরাইশরা তখন সারিবদ্ধভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে অবস্থান করছিল। তিনি তাদের সম্বোধন করে বললেন—হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমাদের সঙ্গে আজ আমি কেমন আচরণ করব বলে মনে করো? সবাই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগল— আমরা আপনার কাছ থেকে উত্তম আচরণ কামনা করছি। তিনি বললেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।’ শুধু তাই নয়, কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের ঘরে যে ব্যক্তি আশ্রয় নেবে, তাকেও তিনি ক্ষমা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃ: ৪০৫-৪০১)
নবীজি (স.)-এর এই অপূর্ব করুণা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত মক্কাবাসী অভিভূত হয়ে পড়ে। সজল নয়নে নির্বাক তাকিয়ে থাকে মহামানবের মুখের দিকে। এমনও কি হতে পারে? জীবনভর যার সঙ্গে শত্রুতা করেছি, চিরতরে শেষ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি, তিনিই আজ এই বদান্যতা, করুণা ও কোমলতা দেখালেন? তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নবীজি (স.)-এর চরণতলে নিজেদের সঁপে দেয়। তারা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ এ সময় যারা ইসলাম গ্রহণ করে, হজরত আবু কুহাফা (রা.) তাদের অন্যতম। তার ইসলাম গ্রহণে মহানবী (স.) যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.)-এর পিতা। মহানবী (স.)-এর এই সাধারণ ক্ষমা পরবর্তী সময়ে ইসলামের ঝান্ডা ওড়ানোর যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এতদিন যারা ছিল তার রক্তপিয়াসী, তারাই হলো এখন দেহরক্ষী। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে চিরদিনের জন্য মিথ্যার ওপর সত্যের জয় হয়। আলোর জয় অন্ধকারের ওপর। এ রক্তপাতহীন বিজয়টি মূলত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উদারতার এবং নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে মানবতার। আল্লাহতায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়, সে যেন জেনে রাখে, অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।’ (সুরা শুরা: ৪৩)
ইসলামের সামগ্রিক পাঠ ও নবীজির সিরাত সামনে রাখলে এ কথাই বুঝে আসে, ইসলাম মানুষের মধ্যে সাম্য-শান্তি ও অহিংসা নিশ্চিত করে। মুসলমান হিসেবে সবার কর্তব্য, ইসলামের মর্মবাণী আত্মস্থ করে পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবন সুন্দর করা।
লেখক: ইমাম ও খতিব
