এনজিও তুষ্টিতে সড়ক নিরাপত্তা আইন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সড়ক নিরাপত্তা আইন-২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পথে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে খসড়া চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান আইনগুলোয় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার না করে আলাদা আইন কেন করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে।অভিযোগ রয়েছে, এই খাতে কাজ করা এনজিওগুলোর পরামর্শে তাদের সন্তুষ্ট করতেই এ আইন করা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপের (জিআরএসপি) প্রেসক্রিপশনে এ আইন করা হচ্ছে।সড়ক নিরাপত্তা আইনের প্রাথমিক খসড়ার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় ধারায় ‘আইন প্রয়োগ’ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, “এই আইনের বিধানাবলি ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ (২০১৮ সালের ৪৭ নং আইন) এবং ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৭’ (২০১৭ সালের ১৭ নং আইন), মহাসড়ক আইন, ২০২১ সহ এতদসংক্রান্ত প্রচলিত অন্যান্য আইনের বিধানাবলির পরিপূরক হইবে।”বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনজিও) তুষ্ট করতে এই আইন করা হচ্ছে কি না—সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। গত সরকারের আমলে আইনটি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন আইনের নাম ছিল ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন-২০২৪’। এখন চূড়ান্ত খসড়ায় আইনের নামে শুধু সাল পরিবর্তন হচ্ছে। মোটাদাগে বাকি সব মৌলিকতা একই থাকছে।জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এগুলো টেকনিক্যাল বিষয়। সচিবের সঙ্গে কথা বলেন।’ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।তবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো যুক্ত করা সম্ভব। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা যেতে পারে। এর জন্য আলাদা আইন করার দরকার নেই। আইনটি হলে সড়ক নিয়ে কাজ করা এনজিও ব্যবসায়ীদের সুবিধা বাড়বে। তারা চাচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আলাদা বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে। এনজিওদের প্রত্যাশার কারণেই আইনটি তৈরি হচ্ছে।যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ‘দেশে আইনের কোনো কমতি নেই, সুপারিশের কোনো কমতি নেই। কমতি হচ্ছে বাস্তবায়নের। একই কাজ যখন তিনজন করে, তখন আসলে কেউ কাজ করে না। একটার পর একটা আইন করে শুধু বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে। এ আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবা জরুরি।’তিনি বলেন, আলাদা একটা বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ করা মানে বিআরটিএকে আরও দুর্বল করে ফেলা। আগেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১২ সচিব মিলে কমিটি হয়েছে। ওই শক্তিশালী কমিটি দিয়েও কাজ হয়নি। কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। বিদ্যমান আইন সংশোধন করে আরও কীভাবে মজবুত করা যায়, কার্যকর করা যায়, বাস্তবায়ন করা যায় এবং বিআরটিএকে আরও শক্তিশালী করা যায়, সে পথ খুঁজে বের করা দরকার।এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন-সংক্রান্ত যে আইনটি করা হয়েছে, সেখানে যাত্রীর নিরাপত্তার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা একটি আইন হতেই পারে। এতে আমি খুব একটা ক্ষতি দেখি না।নিরাপত্তা-সংক্রান্ত স্বতন্ত্র বোর্ডের প্রস্তাব: আইনের খসড়ায় ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা বোর্ড’ নামে একটি অধ্যায় রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ চারজনের বোর্ডে একজন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ থাকা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। সড়ক অবকাঠামোর নকশা, গঠন, রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ এবং নিরাপদ মোটরযান ও নিরাপত্তার মানদণ্ড এই বোর্ড নির্ধারণ করতে চাইছে।এ ছাড়া ৪৩ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এই পরিষদের সভাপতি হবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। সড়ক পরিবহন আইনের অধীনে দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণের জন্য একটি তহবিল তৈরি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করার জন্য ‘রোগী কল্যাণ ফান্ড’ করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।স্বতন্ত্র বোর্ড করার পক্ষে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করার উপকমিটির সদস্য ও ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরান উল বাসেদ বলেন, ‘বিআরটিএর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা চাইলেও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক জায়গায় আনতে পারে না। সড়ক নিরাপত্তার সঙ্গে শুধু সড়ক মন্ত্রণালয় নয়, স্বাস্থ্য, পরিবেশসহ অন্য বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’কামরান উল বাসেদ রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিওর ভাইস চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ তৈরি করার পর এটি যদি সরাসরি সরকার প্রধানের অধীনে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি তৈরি করা সহজ হবে।’আইনে যা যা থাকতে পারে: সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় মোট ১৫টি অধ্যায় রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি তপশিল রাখার প্রস্তাব করা হবে। নিরাপদ মোটরযান এবং মোটরযানের গতিসীমা ও চলাচল নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা হচ্ছে। তবে সড়ক পরিবহন আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ হবে। ওভারটেকিং কীভাবে করতে হবে এবং গাড়ির বাঁক নিতে চালকের করণীয় বিষয়ে খসড়ায় উল্লেখ আছে। মোটরযান মালিকের দায়দায়িত্ব কী হবে, সেটিও আইনে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে।আরেকটি অধ্যায়, সড়ক ব্যবহারকারীর আচরণ কেমন হতে হবে, সে সংক্রান্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যাত্রীরা চালকের সঙ্গে কোন আচরণগুলো করতে পারবে না, সেগুলো উল্লেখ করে কিছু বিধান থাকবে।সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ‘সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা’ শীর্ষক একটি অধ্যায় করা হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে সড়ক দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনা করবে বোর্ড।অপরাধ ও দণ্ড: আইনের খসড়ায় ১০১টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৩৬টি ধারা না মানলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে। শাস্তিস্বরূপ পয়েন্ট কাটা থেকে শুরু করে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।এ আইনে সড়ক নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের এবং সরকারি চাকরিজীবীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় বলা হচ্ছে, সড়কের নকশা, নির্মাণ বা ব্যবস্থাপনার সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উল্লিখিত ১০টি ধারা লঙ্ঘন করলে, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা বা ত্রুটিপূর্ণভাবে পালন করার কারণে কোনো দুর্ঘটনা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।সাধারণ নীতি অনুযায়ী, কোনো আইন পাস করার ক্ষেত্রে সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়; কিন্তু বর্তমানে সংসদ বিদ্যমান নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে অধ্যাদেশ জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারবে।
