নতুন আয়কর আইনে কোম্পানির সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সমিতি, সমবায় সমিতি, এনজিও, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে কোম্পানি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
এ কারণে আগামীতে এ জাতীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের আয় থাকলে করপোরেট কর (২৭.৫ শতাংশ), আর না থাকলে ন্যূনতম কর (গ্রস প্রাপ্তির ০.৬০ শতাংশ) দিতে হবে। পাশাপাশি উৎসে কর কর্তনের বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে। এছাড়া অনেক আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, যা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও আইনে পেশাজীবীদের ৩টি সংগঠনকে ‘বিশেষ’ ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন আইনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ অফিস, রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস বা ব্রাঞ্চ অফিস; যে কোনো বিদেশি সত্তা বা ব্যক্তির স্থায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান; বাংলাদেশের বাইরের কোনো দেশের আইন দ্বারা বা আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো সংঘ বা সংস্থা; ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান; ফার্ম, ব্যক্তিসংঘ, জয়েন্ট ভেঞ্চার বা ব্যক্তিদের সংগঠন বা কোম্পানি আইনে সংজ্ঞায়িত কোনো কোম্পানি বা বিদেশি সত্তাকে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
১ জুলাই থেকে নতুন আইন কার্যকরের কথা ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন আইন কার্যকর হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এনজিও, সুশীল সংগঠন, নাগরিক সংগঠন, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা, সমবায় সমিতিকে অর্থবিল ২০২৩-এর তফশিল ২-এর অনুচ্ছেদ ‘খ’-এর ১(ঈ) অনুযায়ী মুনাফার ওপর কর দিতে হবে, ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা অনুসরণ করে আয়কর দিত। প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও কর দিতে হবে। আইনের ১৬৩ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, করবর্ষে লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে কোম্পানিকে গ্রস প্রাপ্তি দশমিক ৬০ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থাগুলো নিজেদের সুরক্ষায় ব্যাংকে স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়ী আমানত রাখে। সেখানেও বাড়তি কর দিতে হবে। আইনের ১০২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, কো-অপারেটিভ ব্যাংক, ইসলামি নীতিতে পরিচালিত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লিজিং কোম্পানি অথবা হাউজিং ফাইন্যান্স কোম্পানিতে সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত রাখলে, ওই আমানতের বিপরীতে প্রদত্ত সুদ পরিশোধকালে নির্ধারিত হারে উৎসে কর কেটে সরকারি কোষাগারে জমা দেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে সুদ আয় থেকে ২০ শতাংশ উৎসে কর কেটে নেওয়া হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা না দিলে ২০ শতাংশের অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ উৎসে কর জরিমানা হিসাবে কাটা হবে। অর্থাৎ এখানেও করের বোঝা বাড়বে।
কেবল করহার নয়, কোম্পানি করদাতাদের আইনের অনেক বিধিবিধান পালন করতে হয়। যেগুলো সাধারণ করদাতাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন উৎসে কর কর্তন, আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং মানদণ্ড অনুসরণ করে হিসাবরক্ষণ এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দ্বারা প্রত্যায়িত আয় বিবরণী ও স্থিতিপত্র দাখিল করতে হবে। আইনের ৭৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি বা ২ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার রয়েছে এমন ফার্ম, ব্যক্তিসংঘকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দ্বারা প্রত্যয়িত আয় বিবরণী (অডিট রিপোর্ট) এবং স্থিতিপত্রের অনুলিপি রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
আইনের ১৬৯ ধারায় বলা হয়েছে, রিটার্নের সঙ্গে নিরীক্ষিত আয়কর বিবরণী, আর্থিক বিবরণীতে প্রদর্শিত লাভ-ক্ষতি এবং রিটার্নে প্রদর্শিত আয়ের মধ্যকার পার্থক্যের ব্যাখ্যাসহ পৃথক পরিগণনাপত্র জমা দিতে হবে। যথানিয়মে উৎসে কর কর্তন করা হচ্ছে কিনা, সেটি পর্যালোচনার জন্য ১৮৬ ধারায় উৎসে করের রিটার্ন অডিট করার বিধান রাখা হয়েছে। ১৫১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠান যথানিয়মে উৎসে কর আদায় না করলে ওই প্রতিষ্ঠানের কর নির্ধারণের সময় কম আদায়কৃত উৎসে কর প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে আদায় করা হবে। ৩১৫ ধারায় উৎসে কর কর্তন বা সংগ্রহে ব্যর্থতা ও তা সরকারি কোষাগারে ব্যর্থতার দায়ে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। অর্থদণ্ড প্রতিদিনের জন্য সর্বনিম্ন ১০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আর্থিক জরিমানা করতে পারবেন কর কর্মকর্তা।
আইনের ৩২৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি, ফার্ম বা ব্যক্তিসংঘ অপরাধ করলে জরিমানা করা হবে। একইসঙ্গে কোম্পানি পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তি অর্থদণ্ডসহ সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৬ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এক্ষেত্রে পরিচালকদের দণ্ডিত করা হবে না; যদি তারা প্রমাণে সক্ষম হন অপরাধটি তার জ্ঞান, সম্মতি বা পরোক্ষ সম্মতি ছাড়া সংঘটিত হয়েছে, অপরাধটি অবহেলার কারণে সংঘটিত হয়নি এবং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
সৌভাগ্যবান ৩ পেশাজীবী সংগঠন : কর আদায়ের ক্ষেত্র বাড়াতে নতুন আইনে এনবিআর যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও কোম্পানি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে করপোরেট কর, বাড়তি উৎসে করের বোঝা চাপাচ্ছে; সেখানে ৩ পেশাজীবী সংগঠনকে ‘বিশেষ’ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সৌভাগ্যবান ৩ সংগঠন হলো- দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস্ অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)।
এই ৩ পেশাজীবী সংগঠনের স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়ী আমানতের সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কর্তনের বিধান রাখা হয়েছে আইনে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উৎসে কর ২০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, আইনের ষষ্ঠ তফশিলের (কর অব্যাহতি ও রেয়াত) ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিএবি, আইসিএমএবি, আইসিএসবি পরিচালিত পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের (প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট) সুদ বা লভ্যাংশ ছাড়া অন্য যে কোনো আয় করমুক্ত থাকবে। অর্থাৎ এসব সংগঠনকে আয়কর দিতে হবে না।
জানা যায়, নতুন আয়কর আইন প্রণয়নে কর বিভাগের চৌকস কর্মকর্তাদের পাশাপাশি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট খসড়া তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। মূলত তার আগ্রহের কারণেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের সুবিধা ৩ সংগঠনকে দেওয়া হয়েছে। কর কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে আপত্তি তোলেনি।
অর্থনীতিবিদ-ব্যবসায়ী নেতারা যা বলছেন : এ বিষয়ে সাবেক এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, নতুন আইনে স্বল্প ভাষায় অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাই বেশ কিছু জায়গায় স্পষ্টীকরণ দরকার। প্রতিটি সংজ্ঞা-অধ্যায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। যেমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কখনোই একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো কোম্পানি হিসাবে বিবেচনা করা যৌক্তিক হবে না। তাদের করহার কখনোই এক হওয়া ঠিক নয়।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে কোম্পানির সংজ্ঞায় ফেলা ঠিক হয়নি। এ ধরনের সংগঠনকে কেনই বা করপোরেট কর দিতে হবে? এসব সংগঠনে যারা দায়িত্বে আছেন বা সদস্য, তাদের প্রতিষ্ঠান তো করপোরেট কর দিয়ে থাকে। ব্যবসা সংগঠনগুলো নীতি তৈরিতে দেশকে সাপোর্ট দেয়, অ্যাডভোকেসি করে। তাই এ ধরনের সংগঠনের ওপর করারোপ করা উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও কোম্পানির সংজ্ঞায় ফেলার যৌক্তিকতা নেই। কর দিতে হলে শিক্ষার্থী, ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপ পড়বে।
তিনি আরও বলেন, আইসিএবি, আইসিএমএবি ও আইসিএসবিকে কেন বিশেষ সুযোগ দেওয়া হলো তা বোধগম্য নয়। তাহলে ডাক্তার, আইনজীবী বা অন্য পেশাজীবী সংগঠনগুলো কী দোষ করেছে। এটা সমাজে পরিষ্কার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আইন পাশের আগে এসব বিষয়ে সংশোধন আনা উচিত।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।