কষ্টের সাক্ষী ভাঙা সড়ক


মুগদা বিশ্বরোড থেকে মাণ্ডা হয়ে আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের গ্রিন মডেল পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার জন্য গত বছর উদ্যোগ নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এরপর এলাকাবাসীর আপত্তির মুখে রাতারাতি বুলডোজার দিয়ে সড়কের পাশের সব বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সড়কটি ৬০ ফুট প্রশস্ত করার জন্য সড়কটি লন্ডভন্ড করা হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত দেড় মাসের বেশি সময় সড়কটি এলাকার মানুষের কষ্টের সাক্ষী হয়ে আছে। খানাখন্দ এতই গভীর যে, বৃষ্টির পানি জমলে বোঝার উপায় থাকে না এটি পুকুর না সড়ক। এলাকার মানুষের এই দুর্ভোগ কতদিন থাকবে কিংবা কবে এই সড়ক ঠিক হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। একই দশা পড়েছে রাজধানীর মালিবাগ থেকে খিলগাঁও এবং যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ সড়কসহ আরও কয়েকটি জনবহুল সড়ক। বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকা রাজধানীর এসব সড়কের কাজের মান এবং গতি নিয়ে সবার অসন্তোষ থাকলেও কারও যেন কিছুই আসে যায় না। সড়কে ইট, খোয়া বেরিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে গর্তগুলো ভরে যাওয়ায় খানাখন্দে ভরা ভাঙা গর্তের সড়কে চলাচলে নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝুঁকি নিয়ে রিকশা, অটোরিকশা এবং ভাড়ায় চালিত মোটর বাইকে চলাচল করতে গিয়ে পথচারী ও যাত্রীদের সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়, কখন দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তারা। উন্নয়নের নামে খামখেয়ালিভাবে নেওয়া এসব সড়কের কাজের বিষয়ে একরকম নির্বিকার ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। একাধিক থানা প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব সড়কে মানুষের চলাচলে কষ্টের চিত্র দেখা গেছে। জানা গেছে, সড়ক খনন নীতিমালায় বর্ষা মৌসুমে সড়ক কেটে উন্নয়ন কাজকে নিরুৎসাহিত করা হলেও তা অবজ্ঞা করে উন্নয়নের নামে যেন সড়কে তামাশা চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিটি করপোরেশনও তা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেকটা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সমালোচনা এড়াতে এসব কাজের জন্য সেবা সংস্থাগুলোকে দুষছেন তারা। বলছে, সংস্থাগুলো নগর সংস্থার কথা শুনছে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান থেকে লাউতলা খাল সড়কটি ইট, খোয়া, পিচ ঢালাই উঠে গেছে। সড়কটি যে পাকা ছিল, তা এখন আর বোঝার কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি হলেই হাঁটপানি জমে কাদা হয়ে যায়। ওই সড়কে চলাচলকারীদের কষ্টের অন্ত নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ওই সড়কের পাশে লাউতলা খাল উদ্ধার করে সবুজায়ন করলেও সড়কের প্রতি কোনো নজর দেয়নি। চাঁদ উদ্যানের বাসিন্দা ডা. এমএ শিশির বলেন, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তায় প্রায়ই জ্যাম লেগে থাকে। এজন্য বছিলা ও কেরানীগঞ্জের জনসাধারণ এই সড়কটি বেশি ব্যবহার করেন। কিন্তু সড়কটির এখন যে অবস্থা তা চলাচল করাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। পায়ে হেঁটে চলাচল করা যাচ্ছে না। সিএনজি, মোটরসাইকেল ও মিনি ট্রাকগুলোও স্লিপ কাটছে। নিত্যদিনই ওই সড়কে চলাচলে কাদায় স্লিপ কেটে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। রাজধানী শহরের সড়কের এমন অবস্থা চিন্তা করা যায় না। ঢাকা দুই সিটির সম্প্রসারিত এলাকার সড়কগুলোও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ডেমরা, মাতুয়াইল, দক্ষিণগাঁও, মুগদা-মাণ্ডা ও নাসিরাবাদ এলাকার প্রধান সড়ক ও অলিগলিগুলো খুবই নাজুক। অপরদিকে, ঢাকা উত্তর সিটির বাড্ডা, সাতারকুল, ভাটারা, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও তুরাগের প্রধান সড়ক এবং অলিগলি সবই বেহাল। উন্নয়ন কাজ শুরু করলেও কয়েক বছর ধরে কচ্ছপগতিতে তা চলছে। এতে মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। রাজধানীর মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়কগুলো চলাচল উপযোগী থাকলেও অলিগলিতে বর্ষা মৌসুমেও সড়ক উন্নয়ন কাজ চলছে। মাসের পর মাস কাজ না করে সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। বর্ষার মৌসুম হওয়ায় প্রায় ওই সড়কগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকছে। এ অবস্থায় ওসব সড়কে চলাচল করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। মিরপুর ১২ নম্বর উত্তর কালশী (সিরামিক), দুয়ারিপাড়া ক-ব্লক, ইস্টার্ন হাউজিং ও মিরপুর ১১ নম্বরের বেশিরভাগ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। একই চিত্র দেখা গেছে, মহানগরীর আদাবর, শেখেরটেক, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সড়ক, পুরান ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুরের সড়কে। অসহ্য কষ্ট সহ্য করে ওই এলাকার মানুষ চলাচল করছেন। পুরান ঢাকার ৪৮ ওয়ার্ডের কলার আড়ত, কবরস্থান রোড, সায়েদাবাদ পাম্পের গলি, বিবির বাগিচা, সুতি খালপাড় এবং ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের ধলপুর, বাদল সর্দার গলি খুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত রেখেছে ঢাকা ওয়াসা। একই অবস্থা ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের নীনগর, ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের লালমিয়া সরকার রোড, মুরাদপুর মাদ্রাসা রোড, মুরাদপুর মেডিকেল রোড, মুরাদপুর হাই স্কুল রোডসহ ওয়ার্ডে প্রধান সড়ক, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাগানবাড়ি গলি এলাকা, ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের নামা শ্যামপুর, মাদবর বাজার, শাহী মসজিদ রোড, মাদবর বাজার রোড, সালাউদ্দিন স্কুল রোড, সবুজ বাগ, ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেরাজ নগর এ ব্লক, মেরাজ নগর ডি ব্লকের ১, ২ ও ৩ নম্বর গলি, পূর্ব কদমতলী, মোহাম্মদবাগ এলাকার সড়কগুলো খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। একই অবস্থা খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ থেকে মালিবাগ রেল ক্রসিং পর্যন্ত সড়কের। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের জন্য সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। ওই প্রকল্পের অর্থ জটিলতার কারণে কাজও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ওই সড়কে চলাচলে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ মাড়াতে হচ্ছে। দক্ষিণ সিটির ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ দনিয়া শাহী মসজিদ রোড, পুরান ঢাকার ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের পাটেরবাগ, নোয়াখালী পট্টি, দক্ষিণ দনিয়া, আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় রোড, বর্ণমালা স্কুল রোড, একে স্কুল রোড, ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের শেখদি স্কুল রোড, নয়ানগর কুতুবখালী, ছনটেক, গোবিন্দপুর, বাগানবাড়ি, মেধাবাড়ি, শেখদী আব্দুল্লাহপুর মোল্লা স্কুল রোড এবং ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাতুয়াইল কবরস্থান রোড, সুলতানা মেম্বার বাড়ির রোডের অবস্থাও করুন। মানুষের চলাচল উপযোগী নেই ওয়ার্ডের সড়কগুলোর। এছাড়া ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের মাতুয়াইল কবরস্থান রোড, ফার্মের মোড়, মুসলিম নগর, মোগল নগর, কেরানিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলির অবস্থাও খুবই নাজুক। ভুক্তভোগীরা জানান, ওই এলাকায় ঢাকা ওয়াসার পানির পাইপলাইন অনেক পুরাতন ছিল। ওই লাইনে পরিবর্তন করার কাজ করছে নগরীর পানি সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সংস্থা। বেশ আগে কাজ শুরু হলেও ঢিমেতালে কাজ চলায় পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। জুরাইন এলাকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠস্বর মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা ওয়াসা সড়কগুলো খুঁড়ে ফেলে রেখেছে। চলাচলে এলাকার মানুষের খুবই কষ্ট হচ্ছে। বর্ষার মৌসুম হওয়ায় ভোগান্তির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। সড়ক সংস্কারে সিটি করপোরেশনেরও কোনো ভূমিকা নেই। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এলাকাবাসী সংস্থাগুলোয় যাওয়া শুরু করেছি। প্রয়োজনে আমরা আন্দোলনে নামব। মানুষের এই কষ্ট সহ্য করা যায় না। ঢাকা দক্ষিণ সিটির উত্তর শাহজাহানপুর, লালবাগসহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়কেও উন্নয়ন কাজ চলছে। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটির রায়ের বাজার, শেকেরটেক, চন্দ্রিমা উদ্যান, শেরশাহসুরী রোড, নূরজাহান রোডসহ আশপাশের বেশ কিছু সড়ক খুঁড়ে ঢাকা ওয়াসার পানির পাইপলাইন বসিয়েছে। তবে সড়কগুলো এখনো পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। এজন্য ওইসব সড়কে চলাচলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। এছাড়া নতুন করে কুড়িল প্রগতি সরণি সড়কে মেট্রোরেল-১ এর নির্মাণ কাজের জন্য সেবা সংযোগ প্রতিস্থাপন কাজ চলছে। সেজন্য কুড়িল চৌরাস্তা থেকে কালাচাঁদপুর পর্যন্ত সড়কের একাংশ বন্ধ করে কাজ চলছে। এ কারণে বসুন্ধরা গেট, যুমনা ফিউচার পার্কের সামনের এলাকা পর্যন্ত তীব্র যানজট হচ্ছে। বলা চলে ওই কাজের কারণে সড়কের কাজের গতি অনেকাংশে কমে গেছে। আরও দেখা গেছে, হাজারীবাগের গজমহল রোড, শিকারি টোলা সড়কে দীর্ঘদিন ধরে সড়ক সংস্কার কাজ চলছে। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ায় মানুষ চলাচলে রীতিমতো নাকাল হচ্ছেন। একই অবস্থা গুলশান লেকভিউ সড়কের। পিচ ঢালাই, ইট, খোয়া উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকার যানজট কমাতে রাজউক লেক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। সড়কটি ২০১৮ সালে খুলে দেওয়া হয়; দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে সড়কটি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে এখনো কাটাকাটি চলছে। কোথাও কেটে ফেলে রাখা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন সংস্কার করছে না। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরাও জনদুর্ভোগ লাঘবে বিদ্যমান পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে পরিদর্শন শুরু করেছি আমরা। ধাপে ধাপে বেহাল সড়কগুলো সংস্কার করে জনদুর্ভোগ লাঘব করা হবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, পট পরিবর্তনের পর সিটি করপোরেশনের সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম ভেঙে পড়ে। সেখান থেকে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। যেসব সড়ক ভাঙাচোরা সেগুলোও পর্যায়ক্রমে সংস্কার করা হবে। ঠিকাদাররা যেসব কাজ ফেলে রেখেছিল, সেগুলোও শুরু হবে, কিছু কিছু শুরুও হয়েছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন বর্ষার মৌসুমে নিজেরা বা কোনো সংস্থাকে সড়ক খোঁড়ার অনুমোদন দেয় না। আগে থেকে যেসব কাজ চলমান রয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছু কাজ চলছে। এসব কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, কিছু কাজ থাকে প্রকল্পের। সেসব নির্ধারিত সময়ে শেষ করারও টার্গেট থাকে। সেসব ক্ষেত্রে নগর সংস্থাগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় ছাড় দিয়ে থাকে কর্তৃপক্ষ। তবে এর পরিমাণ খুবই নগণ্য।