দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল আযহা। উৎসবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কুরবানির পশু কেনা। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন হাটে জমে উঠেছে গরু বিক্রির রমরমা বেচাকেনা। তবে এ সময় অসাধু ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়, যারা বিভিন্ন রাসায়নিক ও ওষুধ ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে গরুকে মোটাতাজা করে তোলে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হাশেমের মতে, স্টেরয়েড বা অন্যান্য রাসায়নিক প্রয়োগে গরু বাহ্যিকভাবে মোটা ও চকচকে দেখালেও এগুলো স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ। এসব গরুর মাংসে ক্ষতিকর উপাদান থেকে যায়, যা রান্নার পরেও দূর হয় না এবং মানুষের শরীরে নানা রোগের কারণ হতে পারে।
ভালো দাম পাওয়ার আশায় প্রতি বছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে একদল অসাধু ব্যবসায়ি কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই গরু মোটা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করেন। এতে গরুর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে শুরু করে। এতে গরুটির কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃত নষ্ট হতে থাকে এবং গরুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায়।
এছাড়া অনেক গরু খুড়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি থাকে উল্লেখ করে অধ্যাপক আবুল হাশেম বলেন, সুস্থ গরুর দেহের তাপমাত্রা ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়।
এছাড়া খুড়া রোগাক্রান্ত গরুর ক্ষুর ও মুখে ঘা থাকতে পারে, আক্রান্ত গরু খুড়িয়ে হাঁটবে এবং খাবার খেতে চাইবেনা বলেও জানান তিনি।
এছাড়া অনেক গরু কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে। এ ধরণের গরু বেশ বিবর্ণ ও হাড় জিরজিরে হয় বলে তিনি জানান।
কেমন গরু অসুস্থ বা রাসায়নিকযুক্ত?
• অস্বাভাবিক ফোলা: রাসায়নিক দেয়া গরুর শরীরের বিভিন্ন অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে থাকে। চাপ দিলে চামড়ায় গর্ত হয় এবং তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় নেয়।
• শরীরে পানি জমা: শরীর নরম ও থলথলে হয়ে যায়, বিশেষ করে পা ও পিঠে স্পষ্ট বোঝা যায়।
• নিষ্ক্রিয়তা: অতিরিক্ত ওজনের কারণে গরু চলাফেরা করতে চায় না। অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকে, বা ক্লান্ত দেখায়।
• ঝিমিয়ে থাকা: রাসায়নিক প্রভাবের কারণে গরু অলস হয়ে পড়ে, পরিবেশের প্রতি খুব একটা সাড়া দেয় না।
• শ্বাসকষ্ট: হঠাৎ হাঁপানোর মতো করে দ্রুত শ্বাস নেয়।
• লালা ঝরা: স্টেরয়েডযুক্ত গরুর মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা পড়ে।
• খাবারে অনীহা: মুখের সামনে খাবার ধরলে খায় না বা চিবানোর আগ্রহ দেখায় না।
• নাক শুকনা: সুস্থ গরুর নাক সাধারণত ভেজা থাকে, অসুস্থ হলে তা শুকিয়ে যায়।
• রঙ ফিকে: সুস্থ গরুর শরীরের রঙ উজ্জ্বল হয়, অসুস্থ গরু দেখতে বিবর্ণ লাগে।
• গরম শরীর: হাত দিয়ে গরুর গায়ে তাপ বেশি মনে হলে সেটি অসুস্থতার লক্ষণ।
কিভাবে চিনবেন সুস্থ গরু?
• চলাফেরায় চটপটে এবং সচল থাকবে।
• কান ও লেজ দিয়ে মশা-মাছি তাড়ানোর মতো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থাকবে।
• নাক থাকবে ভেজা, মুখে খাবার ধরলে আগ্রহ নিয়ে খাবে বা জাবর কাটবে।
• গরুর পিঠের কুজ হবে শক্ত, মোটা ও দাগমুক্ত।
• শরীরের গঠন ভারসাম্যপূর্ণ হবে, পাঁজরের হাড় স্পষ্ট বোঝা যাবে।
• গরুর রানের মাংস থাকবে টানটান ও শক্ত।
কুরবানির জন্য উপযুক্ত গরুর বৈশিষ্ট্য
১. বয়স: কোরবানির জন্য গরুর বয়স অন্তত দুই বছর হতে হবে। গরুর দাঁত দেখে এটা যাচাই করা যায়। নিচের পাটিতে যদি অন্তত দুটি কোদালের মতো স্থায়ী দাঁত থাকে, তাহলে ধরে নেয়া হয় গরুটি দুই বছরের বেশি বয়সের এবং কোরবানির উপযুক্ত।
২. সম্পূর্ণ সুস্থ: শিং ভাঙা, লেজ কাটা, মুখ, জিহ্বা, ক্ষুর বা পায়ে কোনো ক্ষত থাকলে গরুটি কোরবানির অনুপযুক্ত।
৩. গর্ভবতী গাভী নয়: কোরবানির জন্য গাভী ব্যবহার করা গেলেও অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে সেটি গর্ভবতী নয়। গর্ভবতী গাভীর পেট ও ওলান ফোলা থাকে, এ ধরণের গাভী কোরবানি দেয়া ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশি গরু কেনাই নিরাপদ। কারণ দেশি গরুকে কৃত্রিমভাবে অতিরিক্ত মোটা করা সম্ভব হয় না। তাই কুরবানির পশু কেনার সময় চোখ-কান খোলা রাখা এবং পশুর স্বাভাবিক আচরণ ও শরীরের গঠন খুঁটিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি।
সঠিক পশু নির্বাচন কেবল ধর্মীয় বিধান মানার বিষয়ই নয়, বরং এটি স্বাস্থ্য সচেতনতাও নিশ্চিত করে।