কে-পপে আলোড়ন তোলা বিরোধ, যা বলল নিউজিন্স


কে-পপে আলোড়ন তোলা বিরোধ, যা বলল নিউজিন্স
বিশ্বব্যাপী কোরিয়ান পপ সংগীত বা কে-পপ ব্যাপক জনপ্রিয়। ব্যান্ডগুলোর মধ্যে তুলনামূলক কম সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে ‘নিউজিন্স’। এ ব্যান্ডটির একটি বিশেষত্ব হলো এখানে পারফর্ম করা সব সদস্যই নারী। সম্প্রতি এই নিউজিন্সকে ব্যান্ড ঘিরে কে-পপ জগতে তোলপাড় চলছে। নিউজিন্সের সঙ্গে অ্যাডর লেবেলের (সঙ্গীত কোম্পানি) দীর্ঘদিন ধরে চলা বিরোধের জেরে ব্যান্ডটির কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোরিয়ান আদালত।সাম্প্রতিকালে চার্টে নিউজিন্সের অবস্থান ছিল দুর্দান্ত। এরইমাঝে সিন্ডিকেট ও কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন কে-পপ জগতে বিদ্রোহ করে বসে নিউজিন্স।ব্যান্ডটির পাঁচ সদস্য- হানি, হেইন, হ্যারিন, ড্যানিয়েল ও মিনজি ‘অ্যাডর’ থেকে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোরিয়া এবং বিশ্বজুড়ে ভক্তদের হতবাক করে দেয়।তারা অভিযোগ করেন, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি করা এবং তাদের ক্যারিয়ারকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যাডর। অ্যাডর আদালতে ব্যান্ডটির সঙ্গে করা সাত বছরের চুক্তি (যা ২০২৯ সালে শেষ হওয়ার কথা) বলবৎ রাখার চেষ্টা করে এবং গ্রুপটির যেকোনো স্বাধীন কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা চায়।গত শুক্রবার (২১ মার্চ) একটি কোরিয়ান আদালত এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে; যাতে বলা হয় মামলা চলাকালীন নিউজিন্স কোনো স্বাধীন কার্যকলাপ—যেমন গান প্রকাশ বা বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে পারবে না। অবশ্য এ রায়ের বিরুদ্ধে নিউজিন্স আপিল করেছে।এই রায়কে ‘আঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছে গ্রুপটি।আদালতের এমন রায়ের পর প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছে ব্যান্ডটি। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে অ্যাডরের বিরুদ্ধে হঠাৎ এমন বিদ্রোহের কারণ ও সামনের করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরেছে তারা।ব্যান্ডের সদস্যরা বলেন, ‘এ কথা (অ্যাডর থেকে বেরিয়ে যাওয়া) বলার জন্য আমাদের অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়েছিল। এই লড়াইটা জরুরি।ব্যান্ডটির সদস্য হ্যারিন বলেন, ‘যদিও এটা খুব কঠিন এবং কষ্টকর হবে, আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব এবং আমাদের কণ্ঠ তুলে ধরব। আমরা যা কিছু করেছি, তা ছিল আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।’বিদ্রোহের কারণে সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেক সদস্য হেইন বলেন, ‘অনেকে ভাবে আমরা এতটাই বিখ্যাত যে ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারি, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা অনেক দিন ধরে সবকিছু চেপে রেখেছিলাম; আর এখন এসে আমরা যা ভাবি, যা অনুভব করি এবং যে অবিচার সহ্য করেছি, তা প্রকাশ করছি।’তারকাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করার জন্য কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। ইন্ডাস্ট্রিতে শুধু সফলতা নয়, নিখুঁত হওয়াটাও যেন বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিরোধ খুব কমই জনসমক্ষে আসে। নিউজিন্সের ঘোষণা আসে অ্যাডর এবং তাদের মূল কোম্পানি হাইব-এর সঙ্গে দীর্ঘ ও প্রকাশ্য বিতর্কের পর। দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় মিউজিক লেবেল হাইব, যাদের অধীনে রয়েছে বিটিএস এবং সেভেনটিনের মতো কে-পপ ব্যান্ড।অ্যাডর বিবিসিকে জানায়, নিউজিন্সের সঙ্গে করা চুক্তি এখনও বহাল আছে এবং ব্যান্ডটির অধিকাংশ দাবি ভুল বোঝাবুঝি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আদালত বলেছে, নিউজিন্স চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারেনি বরং অ্যাডর তাদের অধিকাংশ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে; বিশেষ করে অর্থপ্রদান।ব্যান্ডটির সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন আদালত এ রায় দেয় তখন তারা হংকংয়ে পারফর্ম করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন রায়ে ব্যান্ডের সকল সদস্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।ব্যান্ডটি অ্যাডর লেভেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের নাম নিউজিন্স থেকে পরিবর্তন করে ‘এনজেজেড’ রাখে। এনজেজেড থেকে প্রকাশিত প্রথম গান ‘পিট স্টপ’। আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা সেদিন হংকংয়ে পারফর্ম করেন। তবে ভক্তদের জন্য নতুন শুরুর যাত্রাটি তখন শেষ হয়েছিল অশ্রুজল দিয়ে।বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময় ব্যান্ডটির প্রতিটি সদস্য ছিলেন অনেকটাই হতাশ ও দিশেহারা। হানি একসময় কথা বলতে গিয়ে থেমে যান, চোখে পানি চলে আসে। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও যদি সফল না হই, তাহলে সময়ই বলে দেবে ভবিষ্যৎ কী হবে।’২০২২ সালে যাত্রা শুরু করা নিউজিন্স তিন বছরের মধ্যে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। ‘ওএমজি’, ‘ডিট্টো’, ‘সুপার সাই’, ‘অ্যাটেনশন’-এর মতো গানের মাধ্যমে এক বছরেই তারা বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ বিক্রিত গানের দল হয়ে ওঠে।ব্যান্ডটির ৯০’এর দশকের ‘আরএন্ডআর’ এবং হালকা পপের মিশ্রণে তৈরি আলাদা ধাচের গান এবং সহজাত নাচের ভঙ্গিমা কে-পপে নতুন ধারা এনেছে বলে শিকার করেছেন সমালোচকরাও।এই পাঁচ তারকার সাবেক মেন্টর ও অ্যাডরের সাবেক প্রধান মিন হি-জিন যখন ‘হাইব’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এবং ‘হাইব’ও তাকে পাল্টা অভিযোগে সরিয়ে দেয়, তখন থেকেই উত্তেজনা চূড়ান্তে ওঠে। মিন অভিযোগ করেছিলেন, নিউজিন্সকে দুর্বল করতে ‘হাইব’ অন্য একটি গার্ল গ্রুপ চালু করেছে যাদের স্টাইল ছিল প্রায় এক।নিউজিন্স তখন একটি লাইভস্ট্রিমে নীরবতা ভেঙে সরাসরি মিনের ফিরে আসার দাবি তোলে।ড্যানিয়েল বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা জানতাম না তার (মিন) কী অবস্থা, আমরা তাকে সাহায্য করতে পারছিলাম না এবং এটা খুব কষ্টের ছিল; কারণ সে সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন।’অ্যাডর জানায়, মিন সিইও হিসেবে ফিরতে পারবেন না। তবে পরিচালক এবং প্রডিউসার হিসেবে কাজ চালাতে পারবেন। কিন্তু মিন না ফিরলে নিউজিন্স ঘোষণা দেয় তারা অ্যাডর ছাড়বে।অ্যাডর এখন সব দায় দিচ্ছে মিনের ওপর। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘এই সমস্যা মূলত তৈরি হয়েছে সাবেক ব্যবস্থাপনার বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে। সদস্যরা ফিরলে ভুল বোঝাবুঝির সমাধান সম্ভব।’হানি পরে আদালতে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি শুধু অনুভব নয়, নিশ্চিত ছিলাম—এই কোম্পানি আমাদের ঘৃণা করে।’কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, কে-পপ তারকারা ‘শ্রমিক’ হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায়, এ অভিযোগের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।ডিসেম্বরে নিউজিন্স দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়লের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরতদের পাশে দাঁড়ায়—ফ্যানদের জন্য বিনামূল্যে খাবার ও পানীয় সরবরাহ করে আরও এক চমক দেয়।ব্যান্ডটির সদস্যদের বয়স নিয়ে সমালোচনাও এসেছে প্রচুর। অনেকেই বলেছে, তারা ‘সীমা লঙ্ঘন করেছে’, ‘অপরিণত ও বেপরোয়া’ এবং ‘অকৃতজ্ঞ’। তাদের সিদ্ধান্তগুলো তারা নিজেরাই নিচ্ছেন কিনা-এমনও প্রশ্ন করছেন কেউ কেউ।তবে ব্যান্ডটির সদস্যরা বলছেন, বয়স কম মানেই সিদ্ধান্তের মূল্য থাকবে না—এটা ঠিক নয়।হানি বলেন, ‘এভাবেই আমাদের কথা ও চিন্তাকে তুচ্ছ করা হয়। আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, তা আমাদের ভেতরে অনেক গভীর আলোচনা থেকেই এসেছে।’সঙ্গীতে তাদের বিরতি কতদিন চলবে-তা পরিষ্কার নয়। অ্যাডর বলছে, তারা গ্রুপটির সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসতে চায়, কিন্তু নিউজিন্স বলছে, তারা এখনও নিজেকে যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করে না।তবে তারা প্রত্যেকে একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।দুই সপ্তাহ আগে বিবিসির সঙ্গে আরেক সাক্ষাতকারে হানি বলেছিলেন, ‘আমরা সবসময় একে অপরকে বলি, যদি একজন না চায়, তাহলে আমরা কেউই করব না। আমাদের পাঁচজনের সম্মতি ছাড়া কিছু হবে না। এইভাবেই আমরা এখানে এসেছি এবং এভাবেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছাব।জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা পার হবো, অবশ্যই পার হবো।’