কোটা বণ্টনের জটিল পদ্ধতি


বর্তমানে কোটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমেও কোটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় বইছে। কোটা সম্পর্কে অনেকেই অনেক রকম তথ্য দিচ্ছেন। এসব তথ্যের মধ্যে অনেক অমিলও দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ কোটাসংক্রান্ত সার্কুলারগুলোর প্রায় সবই বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিতভাবে জারিকৃত হওয়ায় সবার পক্ষে সব সার্কুলার পাওয়া এবং সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়া সম্ভব না হওয়া। কোটার নির্দেশনাসংক্রান্ত সব সার্কুলার একত্রে পর্যালোচনা না করে কোটানীতি বোঝা অত্যন্ত দুরূহ। চাকরিতে থাকা অবস্থায় কোটাসংক্রান্ত বেশকিছু নির্দেশনা জারির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দেওয়ার কাজের সঙ্গেও জড়িত থাকার কারণে কোটার পদ বণ্টন পদ্ধতি যে কতটা জটিল তা উপলব্ধি করেছিলাম। যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন, তারা নিশ্চয়ই এ জটিল প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন। পদ সংখ্যার কম বা বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে কোটার বণ্টন পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। কোটা শ্রেণিভিত্তিক বণ্টন করতে হয়, সেই সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিটি পদের বিদ্যমান জনবলকেও বিবেচনা করতে হয়। এ ছাড়া আরও কিছু জটিল নির্দেশনা পালন করতে হয়, যা সত্যি একটি দুরূহ কাজ। আদালতের নির্দেশার আলোকে সরকার কোটানীতি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে কোটার বণ্টন পদ্ধতিও সহজ করার প্রয়োজন হবে। অসামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকরিতে জনসংখ্যানুপাতে সব জেলার প্রতিনিধিত্ব সমতাভিত্তিক করার লক্ষ্যে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগেই ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ তারিখে একটি সরকারি সার্কুলার দ্বারা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে সর্বপ্রথম কোটানীতি জারি করা হয়। ওই কোটানীতি অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির পদ ছাড়া অন্যসব শ্রেণির পদ জেলার জনসংখ্যা অনুপাতে পূরণের বিধান ছিল। মেধার ভিত্তিতে পূরণের কোনো বিধান ছিল না। অর্থাৎ ১০০ শতাংশ পদই ছিল জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত। কেবল ১ম শ্রেণির ২০ শতাংশ পদ মেধাভিত্তিক পূরণের জন্য সংরক্ষিত ছিল। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ জেলা কোটার পদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবং ১০ শতাংশ এফেক্টেড নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল এবং ৪০ শতাংশ পদ উন্মুক্ত ছিল জেলার সাধারণ নাগরিকদের জন্য। ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ তারিখে গৃহীত হওয়ার পর সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের অধীনে নতুন করে কোনো কোটানীতি জারি করা হয়নি। সার্কুলার বলে জারিকৃত অন্তর্বর্তীকালীন কোটানীতিতে সময়ে সময়ে কেবল পরিবর্তন করা হয়েছে এবং এসব পরিবর্তনের অধিকাংশই হয়েছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের দ্বারা। প্রথম পরিবর্তন করা হয় ১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল। ওই পরিবর্তনের দ্বারা ১ম শ্রেণির মেধা কোটা ২য় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করা হয় এবং মেধা কোটা ২০ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এছাড়াও ১০ শতাংশ এফেক্টেড নারী কোটায় সাধারণ নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ১৬ নভেম্বর, ১৯৭৬ তারিখে নন-গেজেটেড পদের ১০ শতাংশ কোটা গ্রাম প্রতিরক্ষা ও আনসার সদস্যদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। অতঃপর ২৮ জুলাই, ১৯৮৫ তারিখে ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। অবশিষ্ট ৫৫ শতাংশ পদ জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। এই ৫৫ শতাংশ জেলা কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ মহিলা এবং ৫ শতাংশ উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ফলে ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে জেলার সাধারণ প্রার্থীদের জন্য কোটা থাকে ১০ শতাংশ। ওই সার্কুলারে নন-গেজেটেড সব পদই জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত রাখা হয় এবং জেলা কোটার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ শতাংশ মহিলা, ৫ শতাংশ উপজাতীয়, ১০ শতাংশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ফলে নন-গেজেটেড পদে জেলার সাধারণ প্রার্থীদের কোটা থাকে ৪০ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৩০ জুন নন-গেজেটেড পদের ১০ শতাংশ পদ এতিমখানার নিবাসী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় এবং তা জেলা কোটার বাইরে রাখা হয়। ফলে জেলা কোটার সংখ্যা কমে ৯০ শতাংশ হয়। অন্যান্য বিশেষ কোটা অপরিবর্তিত রাখা হয়; যার কারণে জেলার সাধারণ প্রার্থীদের কোটা ৪০ থেকে কমে ৩০ শতাংশ হয়। ১৪-২০তম গ্রেডের পদে সাধারণ প্রার্থীদের এই ৩০ শতাংশ কোটা অদ্যাবধি বহাল আছে। উল্লেখ্য, ১২ জানুয়ারি, ২০১২ তারিখে ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে ০১ শতাংশ কোটা রাখা হয় প্রতিবন্ধীদের জন্য। তবে এ প্রতিবন্ধী কোটা জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোটায় প্রার্থী না পাওয়ার ক্ষেত্রেই কেবল ০১ শতাংশ কোটা প্রযোজ্য হওয়ার বিধান রাখা হয়। সুতরাং, দেখা যায়, ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ এবং জেলা কোটা ৫৫ শতাংশ ছিল। জেলা কোটা কখনো ৫৬ শতাংশ ছিল না। ১-১৩তম গ্রেডের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা প্রথা বাতিল করার আগে ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে কোটার বিভাজন ছিল : মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ, জেলা কোটা ৫৫ শতাংশ। এই ৫৫ শতাংশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ+মহিলা ১০ শতাংশ+ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ+জেলার সাধারণ প্রার্থী ১০ শতাংশ ছিল। উল্লেখ্য, জেলার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে অপূর্ণ ওই কোটা থেকে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধীদের মধ্য থেকে পূরণ করা যাবে। অর্থাৎ ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ৫৫ শতাংশ জেলার কোটারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। অপরদিকে ১৪-২০তম গ্রেডের পদে কোটার বিভাজন ছিল : ১০ শতাংশ এতিম ও প্রতিবন্ধী কোটা এবং ৯০ শতাংশ জেলা কোটা। এই ৯০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ+মহিলা ১৫ শতাংশ+ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ+আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য ১০ শতাংশ+জেলার সাধারণ প্রার্থী ৩০ শতাংশ। এ কোটা অদ্যাবধি বহাল আছে। মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক