কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্তদের চোখে শুধুই নীরব অশ্রু


কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতদের পরিবার ও স্বজনদের মাঝে চলছে হাহাকার, করুণ আর্তনাদ। স্বজন হারানোর কষ্টে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা শোকে স্তব্ধ। তারা আল্লাহর কাছে বিচার চাইছেন! তাদের দুচোখ বেয়ে ঝরছে নীরব অশ্রু। এক বুক হাহাকার নিয়ে আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে হাসপাতালে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের স্বজনরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হার মানছেন নিয়তির কাছে। সবশেষে স্বপ্নকে কফিনবন্দি করে নিয়ে ফিরছেন বাড়ি। শুক্রবারও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষার্থীসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ঢামেক মর্গ থেকেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৮৮ জনের মৃতদেহ। অপরদিকে আটজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২১৬ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতার আতঙ্কে ভর্তি থাকা গুলিবিদ্ধ ও জখমপ্রাপ্ত অনেকে ঢামেক হাসপাতালের ছাড়পত্র না নিয়েই গোপনে চলে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। রোগীর সহযোগী ছাড়া ওয়ার্ডে অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শুক্রবার যে তিনজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২৩)। তার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছার দেওলী গ্রামে। বাবা নওশের আলী একজন কৃষক। এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে ইমতিয়াজ বড়। নওশের আলী তার বুকের ধনকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করতে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল বিদেশে পড়ানোর। কিন্তু বাবার সেই স্বপ্ন এখন নিথর দেহ। শুক্রবার বাড়ি ফিরলেন ছেলের কফিনবন্দি মৃতদেহ নিয়ে। ইমতিয়াজ বনশ্রীর একটি মেসে থাকতেন। ১৯ জুলাই দুপুরে রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এরপর তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে ওইদিনই জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২২ জুলাই ইমতিয়াজকে সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঢামেকের আইসিইউতে শুক্রবার ভোররাত ৪টার মারা যান তিনি। ছেলেকে হারিয়ে কৃষক নওশের আলী অনেকটাই বাকরুদ্ধ। শুধু বলছেন, ‘আল্লাহ, আমি কি চাইছিলাম, আর আমার কি হলো! আমি এর বিচার তুমি ছাড়া কার কাছে চাইব?’ যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মাইনুদ্দিন (২৫)। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বৃহস্পতিবার রাত ২টায়। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। নিহতের মা মাহফুজা আক্তার জানান, তার ছেলে মাইনুদ্দিন স্ত্রী মায়মুনা আক্তারকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানে একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর শুক্রবার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মাইনুদ্দিনের স্বজনরা কোনো কথা বলতে চাননি। তবে তার মা বলেন, ‘বিচার আল্লাহর কাছে দিয়েছি।’ একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানের সেলসম্যান ছিলেন ইয়াসিন হাওলাদার (১৭)। ২১ জুলাই সে শনির আখড়ায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান ইয়াসিন (১৭)। শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিহতের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ইয়াসিন খুলনার রূপসা উপজেলার রহিমনগর গ্রামের মৃত নূর ইসলামের ছেলে। তিনি ঢাকায় ডেমরার কোনাপাড়ায় থাকতেন। চিটাগাং রোড এলাকায় ফুটপাতে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করত আকাশ (১৬)। পরিবারের সঙ্গে থাকত সাইনবোর্ড এলাকায়। রোববার সকালে আন্দোলনের পরিস্থিতি খারাপ দেখে দ্রুত সে দোকান গোছাচ্ছিল। এমন সময় গুলিবিদ্ধ হয় সে। গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয় হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ময়নাতদন্ত ছাড়াই হাসপাতাল থেকে আকাশের মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি এলাকায় গ্রামের বাড়িতে। আকাশের বাবা আকরাম হোসেন শুক্রবার বলেন, ‘পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) করিয়ে কি করব, আমার ছেলে চলে গেছে। ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। এইজন্য এভাবেই নিয়ে মাটি (দাফন) দিয়েছি।’ শুক্রবার ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে গুলিবিদ্ধ ১৫ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর ২০০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে তিনজনকে। তাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেনের (৩০) বুকে-পিঠে এবং বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ। তার বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা এলাকায়। যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন। ব্যাটারির রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন ইসমাইল। ১৯ জুলাই কাজলা এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ইসমাইল বলেন, আমি এমনিতে জখমপ্রাপ্ত, এরমাঝে প্রশাসনের লোকজনের নজরদারি। আতঙ্কের মধ্যে আছি। এদিকে ঢামেক হাসপাতালের একজন নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে ভর্তি গুলিবিদ্ধ বেশ কয়েকজন রোগী আতঙ্কে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন। খাতায় নাম থাকলেও তাদের ওয়ার্ডে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, গুলিবিদ্ধ যারা এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, তাদের কারও অবস্থাই শঙ্কামুক্ত নয়। প্রতিদিনই চিকিৎসাধীন রোগীদের দু-তিনজন করে মারা যাচ্ছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, এ অবস্থায় হাসপাতালের নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রবেশেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। রোগীর স্বজন ছাড়া কাউকে ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা জানিয়েছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই রোগীর স্বজন ছাড়া অন্য কাউকে ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া বলেন, রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দিকনির্দেশনা কার্যকর করা হচ্ছে।