গডফাদার বাদ চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি
অনলাইন নিউজ ডেক্স
মাদকের ডিলার, মাফিয়া চক্র কিংবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরা (গডফাদার) বাদ। বেছে বেছে চুনোপুঁটিদের পেছনে ছুটছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিক্স)। উপরন্তু অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির ভারে রীতিমতো ডুবতে বসেছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এর মধ্যে রুটিনমাফিক ডিজি পদে একেকজন আসেন, আবার চলেও যান। কিন্তু কার্যত দুর্নীতির লাগাম টানতে ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা’র চেষ্টা করছেন না কেউ।
চুনোপুঁটি : সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি দীর্ঘ তালিকা জমা দেয়। কিন্তু এতে যথারীতি গডফাদারদের কারও নাম নেই। তালিকার বেশির ভাগই মাঠ পর্যায়ের বাহক বা চুনোপুঁটি। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট মাদক ডিলার বা গডফাদারদের কারও নামই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি তালিকায় ঠাঁই হয়নি কক্সবাজারের আলোচিত সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুর রহমান বদি, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সাবেক সংসদ-সদস্য তালিকাভুক্ত মাদক গডফাদার ওমর ফারুক কিংবা ফেনীর নিজাম হাজারীর নাম। সূত্র বলছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১৮৫ জনের তালিকা পাঠায় নারকোটিক্স। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এতে গডফাদার হিসাবে কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তালিকার বেশির ভাগই মাঠ পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতা অথবা বাহক।
তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, রাজধানীর বনানী এলাকার মাদক গডফাদার হিসাবে হিরনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। হিরনের বাবার নাম খোকন শেখ। ঠিকানা : কড়াইল বস্তি, মুসার বাজার (জালাল মিয়ার রিকশার গ্যারেজ)। মাদকসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, হিরন ৫০ পিস ইয়াবাসহ ধরা পড়েন। এভাবে নারকোটিক্সের গডফাদার তালিকায় স্থান পেয়েছেন ২০০ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেফতার হওয়া কড়াইল বস্তির সবুজ আহম্মেদ, ১০০ গ্রাম গাঁজার আসামি কামরাঙ্গিরচরের বাসিন্দা খুরশিদা বেগম ওরফে খুশি, ১ কেজি ২০০ গ্রাম গাঁজার আসামি মৌলভীবাজারের বাসিন্দা সাগর রবিদাস প্রমুখ।
এছাড়া তালিকায় আরও যাদের নাম আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সবুজবাগের বাসিন্দা ৫০ পিস ইয়াবা মামলার আসামি এহসানুল হক ওরফে বাপ্পা, ১২০ পিস ইয়াবা বহনের দায়ে গ্রেফতার হওয়া তুরাগের বস্তিবাসী জয়নাল, গোপালগঞ্জের আয়লাফ আহমদ, ময়মনসিংহের সুরমা বেগম ও চট্টগ্রামের খোকন।
ওপেন সিক্রেট ঘুস বাণিজ্য : বছরের মাঝামাঝিতে এক ইনস্পেকটরের ঘুস বাণিজ্যের অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে নারকোটিক্স। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট ইনস্পেকটরকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। এছাড়া দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অবৈধ অর্থসম্পদ অর্জনের মামলা করেছে দুদক। কিন্তু এতে নারকোটিক্সের পাহাড়সম দুর্নীতি বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ঘুসের রেট আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন দুর্নীতিবাজরা।
সূত্র বলছে, নারকোটিক্সের অনেকটা ওপেন সিক্রেট স্টাইলে দুর্নীতি চলে। বিশেষ করে মদের বার থেকে মাসোহারা আদায়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো রাখঢাক নেই। লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মাদকের স্পট থেকে রীতিমতো গুনে গুনে ঘুস আদায় করা হয়। কিন্তু প্রমাণযোগ্য এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেউ। রুটিন মেনে ডিজি পদে রদবদল হচ্ছে। কিন্তু নারকোটিক্সের দুর্নীতি রয়ে গেছে সেই আগের তিমিরে।
সেই মোস্তাফিজ এখন ডিজি : ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম ভোট চুরির নির্বাচনকালে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন জায়গায় প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়। নির্বাচনকালে নোয়াখালীর ডিসি ছিলেন খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান। এ সুবাদে পরপর দুটি পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব বনে যান। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন আমলা হিসাবে প্রথমে তাকে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার, এরপর জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ নারকোটিক্সের মহাপরিচালক করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসিনার পতনের পর মোস্তাফিজকে স্বৈরাচারের দোসর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তাকে নারকোটিক্স থেকে সরানোর দাবি ওঠে। কিন্তু রাতারাতি ভোল পালটে বিএনপিপন্থি হয়ে ওঠেন মোস্তাফিজ। এমনকি চেয়ার বাঁচাতে তিনি শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, মার্চে অবসরে যাবেন মোস্তাফিজ। কিন্তু বর্তমানে তিনি বিএনপি ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা পরিচয়ে অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। ইতোমধ্যে কতিপয় বিএনপি নেতার মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদবির শুরু করেছেন মোস্তাফিজ।
বরিশাল ক্লাব : মোস্তাফিজের বাড়ি বরিশাল জেলায়। এ সুবাদে নারকোটিক্সে কর্মরত বরিশালের বাসিন্দাদের রীতিমতো পোয়াবারো অবস্থা। বরিশাল বাড়ি হলেই সংশ্লিষ্টদের ডেকে ডেকে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক এমন একাধিক বদলি ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে। বরিশাল বাড়ি হওয়ায় ঘুসের হাট বলে পরিচিত গাজীপুর ‘ক’ সার্কেলে পোস্টিং পেয়েছেন অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত ইনস্পেকটর মোজাম্মেল হক। এছাড়া বর্তমানে পরিতোষ কুমার কুন্ডু নামের এক কর্মকর্তাকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক হিসাবে পদায়নের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। যথারীতি পরিতোষও বরিশালের বাসিন্দা।
অভিযানে ভাটা : এলাকাপ্রীতি, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক স্থবিরতায় ভাটা পড়েছে মাদকবিরোধী অভিযান। খোদ নারকোটিক্সের পরিসংখ্যান বলছে, দিনদিন মাদক উদ্ধারের পরিমাণ কমছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ২২ লাখ ৮ হাজার ৫৪৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। অথচ বিগত সময়ে প্রায় প্রতিবছর মাদক উদ্ধারের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী। যেমন ২০২০, ২১, ২২ ও ২৩ সালে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ যথাক্রমে ২০, ৩৪, ৪৯ ও সাড়ে ৫২ লাখ। তবে মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি, সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক গতিতে। কোথাও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এমনকি বদলি পদায়নে অঞ্চলপ্রীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত একটি বিশেষ দলের প্রতি যারা অনুগত ছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের স্থলে পদায়ন করা হচ্ছে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
আপনি নিজেই হাসিনা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মহাপরিচালক বলেন, এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমি পেশাগত জীবনে সব সময় নির্ভুলভাবে কাজ করে গেছি। বিশেষ দল বা সরকারের আশীর্বাদে কোথাও কোনো পোস্টিং নিইনি।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।