গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি


বিজনেস সামিটের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে অথবা সুপারিশ যদি আমলাতন্ত্রের ফাঁদে ফাইলবন্দি থাকে তাহলে এ রকম বিজনেস সামিট ১০টা করেও কোনো লাভ হবে না। পাশাপাশি সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। তারা স্বস্তিতে ব্যবসা করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এমনতেই আকৃষ্ট হবে। কারণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো সবার জন্য সমান। অপরদিকে দেশি বিনিয়োগকারীই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ বিজনেস সামিট প্রসঙ্গে এমন মূল্যায়ন করেছেন অর্থনীতিবিদ ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা। সামিট পর্যবেক্ষণকারীদের মতে, প্রথমবারের মতো আয়োজিত বিজেনস সামিটে স্বল্পমেয়াদি অর্জন কম। সৌদি আরবের সঙ্গে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়া বড় ধরনের বিনিয়োগের তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি মেলেনি। তবে বাংলাদেশে এক লাখ কোটি ডলারের (এক ট্রিলিয়ন) সম্ভাব্য বিনিয়োগ অর্থনীতির যে স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন করা হয়েছে সেটি বিদেশি উদ্যোক্তাদের নিশ্চয় অনুপ্রাণিত করবে। প্রসঙ্গত ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী বিজনেস সামিট শেষ হয় সোমবার। বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে এ সামিট শুরু হয় গত শনিবার। সেখানে সৌদি আরব, ইউকে, ভুটানসহ ১৯টি দেশের প্রায় তিন শতাধিক উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী অংশ নেন। সামিটের মূল ফোকাস ছিল ২০৪০ সাল নাগাদ দেশ এক লাখ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তর হবে। এ সময় ১০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে। নানা ইস্যুতে সেমিনারের মাধ্যমে বিদেশিদের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সামিটে অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহজনিত সমস্যা, ঘন ঘন বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো ও গুণগত অবকাঠামোর অভাব। এছাড়া আমলাদের মানসিকতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, অর্থায়ন জটিলতা, জমি প্রাপ্তিতে জটিলতা ও ব্যবসার পরিবেশ ঘাটতির কথাও উঠে আসে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, বিনিয়োগ আনতে হলে দরকার সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং ই-কমার্স বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের গুরুত্ব দেওয়া ও বৈশ্বিক মানের কারখানা স্থাপন। ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির বলেন. দেশি কিংবা বিদেশি পৃথক করার চাইতে যে কোনো বিনিয়োগ বাড়াতে আগে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) হোমওয়ার্ক দরকার। ইকোনমিক জোনগুলোতে সবকিছু দেওয়ার পরও কেন বিনিয়োগ কম আসছে তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। তিনি আরও বলেন, ‘বিনিয়োগের জন্য কিছু কমন প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা আছে। বিজনেস সামিটে একই ধরনের প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করা হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়াতে প্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন সেটি হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ বিনিয়োগ করতে গেলে ইট কেনা থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যন্ত স্থানীয় মাস্তানসহ নানা প্ল্যাটফর্মে বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়। নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। দ্বিতীয়ত, সামিটে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চেয়েছে উদ্যোক্তারা। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি জানান, সামিটে উঠে আসা বিনিয়োগের সমস্যাগুলো দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারী উভয়ের ক্ষেত্রে সমান। তবে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করলে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও বাড়বে। আর এটি আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করবে। তিনি বলেন, এখনো গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে একাধিক পথ খোলা আছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুবিধা যেখানে থাকবে বিদেশি উদ্যোক্তারা মুনাফার আশায় ওইসব দেশে বিনিয়োগ করবে। এজন্য আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানসহ আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর যত দেশ বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে, তার পুরোটাই পেয়েছে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। বাংলাদেশও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ বাধা, জ্বালানি সংকট এবং কাস্টসমে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিজনেস সামিটে ব্যবসার বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা এবং সমাধানের সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সুপারিশগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকর করতে হবে। তাহলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হতে বাধ্য। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, বিজনেস সামিটের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সক্ষমতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা। মোটা দাগে আমরা সফল হয়েছি। সৌদি আরব, চীন, ভুটানের মন্ত্রী ও অন্য দেশের ব্যবসা প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরতে পেরেছি। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল-আইনপ্রণেতা ও আমলাদের কাছে ব্যবসার বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা। তাদের বোঝানো বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা আছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী। কিন্তু সময়মতো প্রতিবন্ধকতা দূর করতে না পারলে, আইন সংশোধন না করলে ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন হয় না বললেই চলে। জনশক্তি ও সস্তা জ্বালানি-এ দুটোর ওপর ভর করেই বাংলাদেশের শিল্প এগিয়েছে। স ষ্টা প্রদত্ত এ দুটো খাতে স্বস্তি ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারিনি। সময় এসেছে কাঁচামাল উৎপাদনে নজর দেওয়াসহ পশ্চাৎপদ শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ সারাজীবন আমরা এ দুটো সুবিধা ভোগ করতে পারব না। উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছলে শ্রমের দাম বাড়বে। তিনি বলেন, অপরদিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে অলরেডি সস্তা জ্বালানির সুবিধা থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন প্রয়োজন দেশে মজুতকৃত কয়লা উত্তোলনে মনোযোগ দেওয়া এবং নিউক্লিয়ার ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা। এখন লজিস্টিক খাতে উৎপাদনের ২০-৪০ শতাংশ খরচ হচ্ছে। এটি ১০-১৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে পারলে ব্যবসার সক্ষমতা বাড়বে।