চার বছরে অগ্নিনিরাপত্তার সব প্রস্তাব ফেরত
অনলাইন নিউজ ডেক্স
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে ‘ফায়ার ডিটেকশন অ্যান্ড ফায়ার প্রটেকশন’ কর্মসূচির আওতায় কোনো সংস্কার প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। বিগত চার বছর থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৪) থেকে একাধিক সংস্কার প্রস্তাব ও প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। অথচ সম্প্রতি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাওয়া সাত নম্বর ভবনসহ সচিবালয়ের ৩, ৪ ও ৯নং ভবনও আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে চিঠি দেওয়া হয়।
এদিকে সচিবালয়ের বেশির ভাগ দপ্তরে সার্ভিস লাইনের ক্যাপাসিটির বাইরে গিয়ে যথেচ্ছ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করাসহ ই/এম বিভাগের অনাপত্তি ছাড়া নির্ধারিত প্রাপ্যতার বাইরে বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রাখতে গত কয়েক বছরে অন্তত ২০ দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব চিঠি দেওয়া হয় সচিবের একান্ত সচিব ও উপসচিবকে (প্রশাসন)। কিন্তু এসব চিঠি কেউ আমলে নেননি। ই/এম বিভাগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে। তবে ঝামেলা হওয়ার ভয়ে পরিচয় প্রকাশ করে কেউ মন্তব্য করতে চাননি।
সূত্রগুলো জানায়, সচিবালয়ে আগুনের ঝুঁকি নিরসনে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন ই/এম বিভাগ-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুল ইসলাম। যদিও তিন মাস আগে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। তিনি ২০২১ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এ কর্মকর্তা দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিবালয়ের প্রতিটি ভবনে বিদ্যুতের সার্ভিস লাইনের সক্ষমতা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, চাহিদার হিসাব মেলানো এবং সাব-স্টেশন ও জেনারেটর থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে হালনাগাদ রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। সেখানে দেখানো হয়, সচিবালয়ের কোন ভবন কতটা আগুনের ঝুঁকিতে আছে। কোথায় কোথায় ফায়ার ডিটেকশন এবং প্রটেকশনের ঘাটতি কতটুকু আছে। সেখানে ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু করে আশির দশকের অনেক পুরোনো ইকুইপমেন্টের কথাও উল্লেখ করা হয়।
এ অবস্থায় সংকট নিরসনে দুর্বল ও জরাজীর্ণ সার্ভিস লাইন আপডেট করাসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার একটি প্রস্তাবনা গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। জরুরি এসব কাজ গণপূর্তের থোক বরাদ্দ থেকে করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু সে প্রস্তাবে সম্মতি মেলেনি।
বিদ্যুতের ওভারলোডের কারণে যে কোনো মুহূর্তে সচিবালয়ে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার ছোটখাটো ঘটনা বড় ধরনের আগুনে রূপ নিতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকে সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ইকুইপমেন্টগুলো আপডেট করতে ২০২২ সালে ‘সাসটেইনেবল অ্যান্ড আন-ইন্টারেপ্ট পাওয়ার সাপ্লাই উইথ ফায়ায় সেফটি’ নামে ৭৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু প্রস্তাবটি একনেকে গিয়ে আটকে যায়। বলা হয়, প্রকল্প প্রস্তাবনা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৃতির। এজন্য অনুমোদন করা যাবে না। অথচ বাস্তবে প্রকল্পের প্রতিটি বিষয় ছিল রি-প্লেসমেন্ট বা পুনঃস্থাপন সংক্রান্ত। অভিযোগ রয়েছে, ওই বৈঠকে এটি অনুমোদন করা যাবে না বলে যারা মতামত দেন, তারা কেউ এ বিষয়ে বিষেষজ্ঞ ছিলেন না। সচিবালয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটিকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হয়।
এরপর হাল না ছেড়ে সচিবালয়ে আগুনের ঝুঁকি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গেও বৈঠক করেন ই/এম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু সেভাবে সাড়া মেলেনি। অগত্যা কিছু জরুরি কাজ করার জন্য ২০২৩ সালের প্রথমদিকে শুধু ফায়ার সেফটির জন্য ২৮ কোটি টাকার একটি সংস্কার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সে প্রস্তাবও আলোর মুখ দেখেনি।
সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবিক অর্থে সচিবালয়ে আগুনের ঝুঁকি নিরসনের সব প্রস্তাব ফাইলবন্দি। এটি নিয়ে এখন কথা বলতে গেলে নানারকম সমস্যা হবে। তবে তারা আশা করছেন, এখন হয়তো সবার টনক নড়বে এবং ফাইলবন্দি প্রস্তাবগুলো আলোর মুখ দেখতে পারে।
সচিবালয়ে যথেচ্ছ বিদ্যুৎ ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে সূত্রগুলো জানায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাধিকার অনুযায়ী লাইট, ফ্যান, এসির সংখ্যা হিসাব করে ভবনভিত্তিক বিদ্যুতের সার্ভিস লাইনের মাস্টার ডিজাইন করা আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রাধিকার অনুযায়ী যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা থেকে এসি ব্যবহারের অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে সচিবালয়ের ৮০ ভাগ কক্ষেই এসি ব্যবহার হয়। যার বেশির ভাগ অনাপত্তি ছাড়া সংযুক্ত করা হয়েছে। আবার প্রকল্প থেকে এসি এনে ইচ্ছামতো লাগানো হয়। এছাড়া যে যার ইচ্ছামতো বেশির ভাগ কক্ষে ফ্রিজ, ওভেন, ইলেকট্রিক কেতলি ব্যবহার করছেন। এমনকি রুম হিটারের ব্যবহারও বেড়েছে। অথচ সার্ভিস লাইন রয়ে গেছে আন্ডার সাইজ। যে কক্ষে একটি ফ্যান ও ২টি লাইট জ্বালানোর ক্যাপাসিটি হিসাব করে সার্ভিস লাইন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে যদি এভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়ানো হয়, তাহলে ওই সার্ভিস লাইন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা সহজে অনুমান করা যায়। এ কারণে সচিবালয়ের বেশির ভাগ অফিস কক্ষের সার্ভিস লাইন কমবেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
এছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং বিপদের বিষয় হলো-অস্বাভাবিক ইন্টেরিয়র। মন্ত্রী ও সচিবের কক্ষ ছাড়াও অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তার কক্ষে ইন্টেরিয়র শোভা পায়। আবার মন্ত্রী-সচিব পরিবর্তন হলে অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে ইন্টেরিয়র করা হয়। ইন্টেরিয়র করতে গিয়ে যথেচ্ছ স্পট লাইট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সার্ভিস লাইনের ক্যাপাসিটি নিয়ে একবারও ভাবা হয় না। অপরদিকে সৌন্দর্য বাড়াতে মন্ত্রণালয়গুলোর করিডরও এখন অত্যাধুনিক ইন্টেরিয়র করা হয়েছে। অথচ কোনো কারণে আগুন লাগলে এগুলো অতিদাহ্য পদার্থ হওয়ায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়বে। যে সাত নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে, সেখানেও প্রতিটি ফ্লোর ও বেশির ভাগ কক্ষ ইন্টেরিয়রে ঠাসা।
অপরদিকে সচিবালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ হচ্ছে বছরজুড়ে। এখানেও মন্ত্রী ও সচিবের দপ্তর ছাড়াও হরহামেশা সারা বছর সংস্কারের কাজ চলে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পছন্দ না হলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ফিটিংস ও টাইলস বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে বিদ্যুতের সংযোগ ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ছাড়াও বিদ্যুৎ ব্যবহারের চাপ বাড়ানো হয়। অথচ সিভিল বা অবকাঠামো খাতে বছরে উন্নয়নের জন্য ২৪ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ থাকলেও ই/এম খাতে বরাদ্দ মাত্র সাড়ে ১০ কোটি টাকা। তাও এটি শুধু সচিবালয়ের জন্য নয়, একেবারে শাহবাগ পর্যন্ত ই/এম বিভাগ-৪-এর আওতায় অনেক প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে প্রটেকশন ডিভাইসগুলো সেভাবে এখন কাজ করে না। যে কারণে অফিস চলাকালীন ছোটখাটো শর্ট সার্কিটের ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। কয়েক মাস আগে ৯নং ভবনেও শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরে যায়। অবশ্য তা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
সচিবালয়ে ডিপিডিসির ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎলাইন থেকে ১১ হাজার ভোল্টেজে নামিয়ে এনে সেখান থেকে ৪০০ কেভি সাপ্লাই দেওয়া হয়। এজন্য এসব প্রক্রিয়ায় কাজ করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাবস্টেশন, ট্রান্সফরমার এবং এমটিবি বা মেইন ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড। রয়েছে আনুষঙ্গিক ইলেকট্রো মেকানিক্যালের বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট। যার অধিকাংশ হালনাগাদ বা আপডেট করা প্রয়োজন।
এদিকে সচিবালয়ে অগ্নিনিরাপত্তার এরকম ঝুঁকির বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অনেকে এড়িয়ে যান। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, এ কথা সত্য যে সচিবালয়ের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তবে সেগুলো কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তিনি জানান, মূলত মাস্টার প্ল্যানের আওতায় পর্যায়ক্রমে পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে ফেলে সেখানে ২৫ তলা উচ্চতার বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে সচিবালয়ের পশ্চিম পাশে এরকম নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ ওই ভবনের অফিসগুলো নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হবে। তারপর সেখানেও নতুন করে ২৫ তলা ভবন নির্মাণ হবে। তিনি মনে করেন, নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হবে বলে অনেকে হয়তো বিদ্যুৎ লাইন সংস্কারের দিকে নজর দিতে চাননি।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, ‘এ মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পরপরই আগুনের ঘটনাটি ঘটেছে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের অনেক বিষয়ে এখনো আমার কাছে আপডেট তথ্য নেই। এ কারণে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফায়ার সেফটি সুরক্ষার জন্য কোনো প্রস্তাব আগে পাঠিয়েছে কি না, সেটি এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, আগুনের নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে সচিবালয়ের ভবনগুলোয় অনেক সমস্যা বিদ্যমান। তদন্ত হচ্ছে। বিস্তারিত প্রতিবেদন আসার পর সবই জানা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকি নিরসনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর কিছু পদক্ষেপ থাকবে দীর্ঘমেয়াদি।’
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।