ছুটছে খেলাপি ঋণের পাগলা ঘোড়া


গত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বের করে নেওয়া ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। ফলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়ছে। ডিসেম্বরের হিসাব তৈরি হলে এ হার আরও বাড়তে পারে। এদিকে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক প্রায় পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকা। যা দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। শুধু চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের ৩ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সব মিলে ৯ মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তখন দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হচ্ছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। এই সময় সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ অনেকটা বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরও বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আগামী দিনে আরও বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মূল্যায়ন : ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী। কমিটি আরও জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। শুধু একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত ১ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। কমিটির প্রধান ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন। জিম্মি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক : শ্বেতপত্রে ব্যাংক খাতের নানা সূচক তুলে ধরে বলা হয়, রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাংক আইন পরিবর্তন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নীতিমালাও পরিবর্তন করা হয়েছে। স্বতন্ত্র পরিচালকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। এমনকি অভ্যন্তরীণ ও বহির্নিরীক্ষক যথাযথ ভূমিকা রাখেনি। নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জিম্মি করে ফেলা হয়। নতুন সরকার গঠিত হওয়ায় ব্যাংক খাতকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে রক্ষা করার সুযোগ হয়েছে। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে নতুন কোনো স্বজনতোষী পুঁজিবাদ যাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ১০টি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। এর মধ্যে ২টি সরকারি ব্যাংক ও ৮টি বেসরকারি ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকের বেশিরভাগ শরিয়াহভিত্তিক। এই ১০ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুরো খাতের ৩৩ শতাংশ ঋণ, আর ৩২ শতাংশ আমানত। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, এসব ব্যাংক কারিগরিভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং তাদের তারল্য নেই। তবে তা তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়নি। বিতরণের ৩০% ঋণ খেলাপির শঙ্কা : ব্যাংক খাতে জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা, স্পেশাল মেনশন হিসাবে ছিল ৩৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা, আদালতের স্থগিতাদেশে খেলাপিমুক্ত ছিল ৭৬ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার ঋণ। ফলে জুন শেষে মোট দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। শ্বেতপত্র হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে, প্রথমে সাড়ে ১২ শতাংশ, এরপর তা ১৫ শতাংশ, বর্তমানে ১৭ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। খেলাপি আগেই হয়ে আছে, এখন তা হিসাবে আসবে। এটা কমিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তদারকি জোরদার করতে হবে, যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পরীক্ষা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে করা হচ্ছে। প্রথমে ১২টি ব্যাংক ও পরে ২০টি ব্যাংকে নিরীক্ষা করা হবে। এতে তাদের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে।’ আহসান এইচ মনসুর বলেন, এরপর এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেবে, তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে গ্রাহক আস্থা ফিরে পাবে। তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আইন করা হচ্ছে। পাচারের টাকা ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।’ ২০১৭ সাল ও এরপরে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। একই সময়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার পরিবার। এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আগামী দিনে খেলাপি ঋণের অর্ধেক বা আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে এস আলম, সাইফুজ্জামানসহ বড় কয়েকটি গ্রুপ ও অসাধু ব্যবসায়ীর।