বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দারুণ আগ্রহ ও পেশাদারত্ব নিয়ে আর সমন্বিতভাবে ইন্টারসেকশন (ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) সামলাচ্ছে। প্রায় সবাই তাদের কথা মেনে চলছে। এ অবস্থা দেখে সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এত বছর কাজ করে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় আমার ভয় হচ্ছে যে, ওরা যখন ক্লাসে ফিরে যাবে, তখন কি আবার শুনতে হবে, সড়ক ব্যবহারকারীরা ট্রাফিক আইন মানে না? এ প্রশ্নটির সূত্র ধরে আমার অভিজ্ঞতা ও স্বল্প জ্ঞানের আলোকে চেষ্টা করব ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে কী কী করলে ওদের এ প্রচেষ্টা টেকসই হবে।প্রথমেই একটা বিষয়ে দৃষ্টি ফেরাতে চাই, আর তা হলো-ইতোমধ্যে তাদের এ উদ্যোগ অনেক প্রশংসিত হলেও কিছু ক্ষেত্রে অনেকে তাদের ভোগান্তির বিষয়টি তুলে আনছেন। বিশেষ করে অনেক ক্ষেত্রে একই সড়কে বারবার ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করা বা ডিরেকশনের ভিন্নতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলেও কেউ কেউ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করছেন। এক্ষেত্রে আমার মত হচ্ছে, যে কোনো শৃঙ্খলিত বিষয়ই কষ্টকর মনে হয়। যেমন, যিনি ভালো খেলোয়াড় বা ভালো গায়ক হতে চান, তাকে কিন্তু সকালের ঘুম ত্যাগ করে ভোরেই প্র্যাক্টিস করতে হয়। অন্যদিকে পরীক্ষায় ভালো নম্বর যে পেয়েছে সে জানে কত নির্ঘুম রাত, কত মুভি-সিরিয়াল সে দেখতে পারেনি।আমাদের সব ধর্মেই একটা কথা আছে-পরকালে বেহেশত বা স্বর্গ পেতে হলে দুনিয়াটাকে জেলখানা বানাতে হবে। অর্থাৎ শৃঙ্খলা সবসময় কষ্টকর। তবে যদি কোনো চালক নিয়ম না মানে, শুধু তখন তার কাগজ চেক করলে হয়তো এ ধরনের ভোগান্তি কমতে পারে। আজ যেসব সড়কে এ বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে, সেই সড়কগুলো কিন্তু আমরা খুব অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করেছিলাম। এসব সড়কের মোড়ে মোড়ে আমরা বাড়তি কোনো জায়গা না রেখেই ভবন উঠতে দিয়েছিলাম। এ সড়কগুলোতে কত গাড়ি চলতে পারবে সেটা হিসাব না করেই এতদিন আমরা ইচ্ছামতো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়েছিলাম। এসব সড়কেই আমরা একই রুটে ইচ্ছামতো বাস চলতে দিয়েছি, আবার সেগুলো কোথায় থামবে বা কোথা থেকে যাত্রী উঠবে, সেটা চিহ্নিত করে দেইনি। এ সড়কে যারা গাড়ি চালাবে, তাদের সবার সঠিক লাইসেন্স আছে কিনা, তা নিশ্চিত করিনি।আবার সবাই যে সঠিকভাবে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছে, সেটাও নয়। তাই এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ওরা যখন একটা শৃঙ্খলা আনতে চাচ্ছে, তখন এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হবে। আর আমি এটাও নিশ্চিত যে, এত কিছু সামলে একজন ট্রাফিক পুলিশের কাজ যে কতটা কষ্টকর হয়, আমাদের দেশে সেটাও তারা অনুধাবন করছে। ইন্টারসেকশন হলো একটা সড়কের খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং পুরো সড়কের ভালো নকশা করেও যদি ইন্টারসেকশনের অবস্থা ভালো না হয় তাহলে খুব একটা সুফল আসে না যানজট নিয়ন্ত্রণে। আবার ইন্টারসেকশন যদি ভালোভাবে ডিজাইন করা যায়, তাহলে সংযোগ সড়কের বেহাল অবস্থা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যায়।এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে হাতের ইশারায় সিগন্যাল ব্যবস্থা বহুলপ্রচলিত। তাই ইন্টারসেকশনে একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে-যখন একদিকের গাড়ি চলছে এবং অন্যদিকের গাড়ি অপেক্ষা করছে, তখন চলন্ত দিকের গাড়িকে থামিয়ে এরপর কোন দিকের গাড়িকে আমাদের ছাড়তে হবে? এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, যদি অন্যসব বিষয় ঠিক থাকে, তাহলে একটি ইন্টারসেকশনে গাড়ি ছাড়তে হবে ক্রমান্বয়ে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। অর্থাৎ যদি চার রাস্তার সংযোগস্থল হয়, যেখানে চারদিকে চারটি রাস্তা আছে, সেখানে যেদিকের রাস্তার গাড়ি ছাড়া হয়েছে, সেদিকের গাড়ি চলাচল কিছুক্ষণ পর বন্ধ করে ছাড়তে হবে ওই রাস্তা থেকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে যে রাস্তা আছে সেদিকের গাড়ি।চিত্রে A, B, C, D-এই চারটি রাস্তার একটি সংযোগস্থল দেখানো আছে এবং চিত্রমতে A-এর গাড়ি দিক চলমান আছে এবং B, C, D-এর দিকের গাড়ি অপেক্ষমাণ। এখন A-এর দিকের গাড়িকে বন্ধ করে ছাড়তে হবে B রাস্তার গাড়িকে, যাতে করে A থেকে শেষ মুহূর্তে যে গাড়ি বের হয়ে গেছে, তার সঙ্গে B দিক থেকে আগত গাড়ির দূরত্ব সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। ফলে ইন্টারসেকশনে সমস্যা হবে না। তবে কোনো কারণে যদি সামনের রাস্তায় গাড়ির চাপ থাকে, তখন ওই সময়ের অবস্থা বুঝে যেদিকে চাপ কম, সেদিকে ছাড়তে হবে। এছাড়া ইন্টারসেকশন থেকে অন্তত ৫০ মিটার বরাবর রাস্তায় কোনো ধরনের পার্কিং, দোকান বা স্টপেজ বন্ধ করতে হবে।গত কয়েকদিন রাস্তায় ঘুরে একটা ব্যাপার ভালো লেগেছে যে, ছেলেমেয়েরা বাঁ দিকে যাওয়ার রাস্তা ফ্রি রাখতে পারছে। অনেক বড় ইন্টারসেকশনে বাঁ দিকের গাড়ির জন্য আলাদা চ্যানেল করে দেওয়া থাকে; কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সড়কে বাঁ দিকের রাস্তা যে ফাঁকা রাখতে হয়, এটা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আর চালকরাও এতদিন মেনে চলত না। আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত আমরা যেভাবে ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট করছি, তাতে করে একদিক যখন চলমান, তখন অন্যসব দিকের গাড়িকে বন্ধ থাকতে হয়। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে ডানে টার্ন নেওয়া গাড়ি। আমরা যদি ডান দিকে টার্ন নেওয়া গাড়িকে ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে কিন্তু একসঙ্গে দুই দিকের গাড়িকে চলতে দিয়ে ক্যাপাসিটি দ্বিগুণ করতে পারি।বিষয়টি কিছুটা জটিল, কিন্তু চালক সহায়তা করলে আর নজরদারি থাকলে এটা সম্ভব। এক্ষেত্রে একটা ইন্টারসেকশনের বিপরীতমুখী দুই রাস্তা থেকে একসঙ্গে সোজা ও বাঁয়ের গাড়ি চলবে, কিন্তু যারা ডানে যাবে তাদের ডানের লেনে অপেক্ষা করাতে হবে। এর কিছুক্ষণ পর একসঙ্গে দুই দিকের ডান লেনের অপেক্ষমাণ গাড়িকে ছেড়ে ইন্টারসেকশন অতিক্রম করতে দিতে হবে। এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, একসঙ্গে দুই দিকের গাড়ি সবসময় চলমান আছে। তবে চালক সহায়তা না করলে বা ইন্টারসেকশনের আগে থেকেই ডানে যাবে এমন যানবাহনকে ডানের লেনে না রাখলে বিষয়টি ম্যানেজ করা ছেলেমেয়েদের জন্য একটু কষ্টকর হতে পারে।লেখায় বারবার চালকদের সহযোগিতার কথা বলছি; কারণ এ কয়েকদিন রাস্তায় ঘুরে দেখেছি, অনেক চালক ঠিকমতো নিয়মগুলো মানতে চাচ্ছে না বা বাধ্য হয়ে মানছে এবং ভয় হচ্ছে-ছেলেমেয়েরা চলে গেলে পরে ট্রাফিক পুলিশ যদি এটা খেয়াল না করে, তাহলে আবার পুরোনো বিশৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস, চালকদের দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততা আর তারা নিয়ম মেনে চলার সুফল না জানার কারণে এটা করছে। তাই আমার মতে, ছাত্রছাত্রীরা যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে, সে জায়গা থেকে তারা একটা গ্রুপ করে চালকদের বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তা নিয়ে তাদের মাঝে রাস্তায় নিয়ম, আইন, চলাচলের শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে যদি আলোচনা করে, তাহলে রাস্তায় এসে তাদের পরিশ্রম অনেক কমে যাবে।এক্ষেত্রে কিছুদিন পর ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ছাত্রদের অবসর সময়ে কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সচেতনতা কার্যক্রম ইত্যাদি কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিলে দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চালক-মালিক-শ্রমিক সংগঠনকেও বুঝতে হবে, সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখলে প্রত্যেকেরই লাভ। ট্রাফিক পুলিশ, ছাত্রছাত্রী ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে একইসঙ্গে এ সচেতনতার কাজ চলমান রাখতে হবে। অনেক বেসরকারি সংস্থা আগে থেকেই এ ধরনের কাজ করে। তারাও এ বিষয়ে তাদের লজিস্টিক, এক্সপারটাইস ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতে পারে।অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খোলার দিনে অনেক গাড়ি রাস্তায় চলে। ছেলেমেয়েরা হিমশিম খেয়ে যায়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ট্রাফিক পুলিশ ফিরে আসুক। আমরা জানি, আমরা সড়কে যত অব্যবস্থাপনা করেছি, তা সামাল দেওয়ার সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছি ট্রাফিক পুলিশের ওপর। আমার ধারণা, ছেলেমেয়েরা এতদিনে বুঝতে পেরেছে কতটা চাপ, কতটা অপ্রতুল লজিস্টিক আর অসচেতন সড়ক ব্যবহারকারীদের সামলে ট্রাফিক পুলিশকে কাজ করতে হয়। আমরা সবাই চাই সড়কে শৃঙ্খলা আসুক, আইন প্রয়োগ হোক। তবে সেটা শুধু আমার জন্য-এ মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার।কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ : সহকারী অধ্যাপক, অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বুয়েট; দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।