জনগণ চায় একটি পক্ষপাতহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন


জনগণ চায় একটি পক্ষপাতহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন
ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন হিসেবে নিজেদের পরিচয় উপস্থাপন করার অভিনয় করলেও, ক্রমবর্ধমানভাবে এই সরকার আদর্শগত পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য সংবিধান রক্ষা, সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের পথ নির্মাণ একান্ত অপরিহার্য। সংবিধানিক নীতিমালার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও অত্যন্ত জরুরি।ইউনূস সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এমন কিছু প্রবণতা প্রদর্শন করেছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বকে শুধুমাত্র খাটো করে দেখানোর ইঙ্গিত দেয় না—এমন আচরণ অনেকের দৃষ্টিতে আদর্শগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ও উপদেস্টা হিসেবে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বা খণ্ডিত ব্যাখ্যায় ব্যস্ত, কিংবা চিহ্নিতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একইসঙ্গে এই সরকার রাষ্ট্রীয় বক্তব্যে “নিরপেক্ষতা” ও “টেকনোক্রেট শাসন”–এর মতো বিমূর্ত ধারণার উপর জোর দিলেও, এই সরকার ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত।যদিও জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক ইসলামবাদের প্রতি স্পষ্ট বিরূপতা রয়েছে, তবুও ইউনূস প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক নেটওয়ার্কগুলোকে গোপনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার অভিযোগ উঠেছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে ১৯৭১ সালের গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতিশোধপরায়ণ রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাব হিসেবে দেখছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক শক্তি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনগুলোর বড় ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে অতীতে জামায়াতকে রাজনীতি থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী, ইউনূস প্রশাসন জামায়াতে ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে গোপন আঁতাতে লিপ্ত। যার মধ্যে রয়েছে নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি)—যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ইউনূস নিজেকে পরিচয় করিয়েছে। এ ছাড়া কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তার সংযোগ রয়েছে, যারা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এসব গোষ্ঠীকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে ইউনূস সরকারের।সমালোচকেরা বলছেন, এটি কেবল রাজনৈতিক চাল নয়, বরং একটি কৌশলী প্রয়াস যার লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রকে দুর্বল করা ও ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে কোণঠাসা করা—বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে দমন করে পশ্চাদপদ ও প্রত্যাখ্যাত শক্তিগুলোকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা।বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর সারাদেশে গণহিংসা একটি বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থকদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা্র প্রায় সবই ইসলামপন্থি চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং একটি ছাত্র সংগঠনের নির্দিষ্ট অংশের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার মাঝে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সাধারণ নাগরিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে যাচ্ছে, যার মূল কারণ রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা ও গণ-ভয়ভীতি প্রদর্শন। ইউনূসের কথিত মেটিক্যুলাস ডিজাইনের আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া এনসিপি বর্তমানে বিতর্কিত ও আলোচিত একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এনসিপি-সংশ্লিষ্ট বা অনুপ্রাণিত মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা সংঘটিত গণ-নির্যাতন, হামলা এবং সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস পৃথিবীর যে কোন ধ্বংসযজ্ঞকে হার মানিয়েছে। ইউনূস সরকারের সঙ্গে একপ্রকার পর্দার আড়ালে সমঝোতার মাধ্যমেই এনসিপি গত মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।ইসলামপন্থি গোষ্ঠীকে প্রভাবশালী করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমূল্যায়ন এবং একটি প্রধান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ বা কোণঠাসা করার যৌথ প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা ও ভবিষ্যতের জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আইনি কুটচালের আবর্তে নিষিদ্ধ করা।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, একটি এমন দল যার ঐতিহাসিক ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের প্রাণের সংগঠন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানের বিরুপ পরিস্থিতেও আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচালিত জরিপে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন পাচ্ছে।আইনি কৌশল কিংবা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যদি একটি নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলকে বাদ দেওয়া হয়, বা তাদের স্বাভাবিক অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হয় – তাহলে সে নির্বাচন জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে শুধু পক্ষপাতদুষ্ট, সাজানো, অন্যায্য ও অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে না, এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা, গনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্থবির করে তুলবে।বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কেবল একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়—এটি গণতন্ত্র রক্ষার ভিত্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত, এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। প্রধান অংশীদারদের বাদ দিলে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি জনগণের একটি বিশাল অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, সমাজে বিভাজন তৈরি করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলবে।