জনমনে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা


জনমনে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায় পুরো দেশ। ইতোমধ্যে নানামুখী প্রস্তুতিও শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোও নেমেছে ভোটের মাঠে। দীর্ঘদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত সাধারণ মানুষও নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। তবে সব পক্ষের প্রস্তুতি থাকার পরও নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা যেন কাটছেই না। বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্যে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও আছে অসন্তোষ। এর সঙ্গে রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নানা ‘উসকানি ও ষড়যন্ত্র’। সবশেষ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দেশবাসীকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন বানচালে হঠাৎ আক্রমণ আসতে পারে। এতে জনমনে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণ মানুষও কিন্তু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা বলছেন। এমন পরিস্থিতিতে খোদ সরকারের পক্ষ থেকেই যদি নির্বাচনে আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়; এটা তো মানুষের আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা আরও বাড়াবে। একই সঙ্গে যারা নির্বাচনকে বিতর্কিত ও বানচাল করতে চায়, এ ধরনের বক্তব্য তাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করতে পারে। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে আস্থা ফেরানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ‘ওয়ার্ক টাইম’ ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে রাজনীতিবিদরা বলছেন, এই ধরনের কথাবার্তার সারমর্ম খুব ভীতিকর এবং সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কের। সরকারের পক্ষ থেকে আরও বেশি জনমুখী ও জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নমূলক কথাগুলো আসা উচিত ছিল বলেও মনে করেন তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনে আগে এসব নিরাপত্তা হুমকি সরকারকেই দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করার আহ্বান জানান রাজনীতিবিদরা। নির্বাচন বানচালের জন্য অনেক শক্তি কাজ করবে-বুধবার এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন প্রস্তুতিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রথম সমন্বয় সভায় তিনি এ সতর্কবার্তা জানিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচন বানচালে দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করছে। এটি ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি। ওই শক্তি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। তবে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। যতই ঝড়ঝঞ্ঝা আসুক, আমাদের সেটা অতিক্রম করতেই হবে। জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, এত লোককে বাদ দিয়ে ইলেকশন হতে পারে না। এটার ইন্ডিকেশন হলো-তারা নির্বাচনকে বানচাল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন বানচালে দেশের ভেতর এবং বাইরের শক্তি তৎপর। আমরাও কিন্তু দেশের ভেতর এবং বাইরের সেই অপশক্তিগুলো কারা, সেটা দেখছি। আমাদের পাশের যে রাষ্ট্র আছে, তারা কখনো চায় না বাংলাদেশ স্থিতিশীল থাকুক। আরেকটা বিষয় হলো জুলাই সনদ। এটা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, এর সঠিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন সম্পর্কে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তিনি আরও বলেন, এখন সব মিলিয়ে শেষ কথা হলো-নির্বাচনসংক্রান্ত যে আশঙ্কা, তা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রথমে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করা। সবার জন্য সম্মানজনক একটা সমাধান দরকার। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে-দেশের বাইরে এবং ভেতরের যে অপশক্তি আছে, তা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য। প্রফেসর ড. ইউনূস যে কথা বলছেন, সেটা যদি সত্য হয়, আমি তো মনে করি সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলকে ডেকে একটা কনভেনশন করে দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, দেখেন সাধারণ মানুষও কিন্তু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা বলছেন। এর কতগুলো কারণও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিষয়ে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটা এখন যেভাবে আছে, এভাবেই যদি থাকে, ভায়োলেন্স ছড়ানোর একটা চেষ্টা তো হবেই। আওয়ামী লীগ নিশ্চয় চেষ্টা করবে, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে সেটা যেন আন্তর্জাতিক কোনো ক্রাইটেরিয়াতেই গ্রহণযোগ্যতা না পায়। আর তাদের তো একটা বিরাট ওয়ার্ক পার্টনার আছে। ফলে তাদের দিয়ে তারা সেই চেষ্টা করবে। তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে এখনো থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া এবারে নির্বাচন সামনে রেখে প্রচুর মিস ইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশনের কারণেও এটা ভায়োলেন্সের ফিগারিং ফ্যাক্টর হতে পারে। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোরাল অবস্থানটাও দেখতে হবে। ফলে এবারের নির্বাচন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা নির্বাচন হবে। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ধাপে ধাপে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলে ঝুঁকি কম হতে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ওয়ান বাই ওয়ান কাজে লাগাতে পারবে। ফলে সরকারের উচিত হবে খুব দ্রুত একটা ওয়ার্ক টাইম তৈরি করে ফেলা। তফশিলের আগে যত ধরনের কাজ আছে সব তাদের শেষ করতে হবে। কারণ, আমি মনে করি তাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরা তো আশা করেছিলাম সরকার আরও বেশি দায়িত্বশীল হবে। কথাবার্তায় আরও বেশি সংযত হবে। জনমুখী ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নমূলক কথাগুলো তাদের কাছ থেকে আসা উচিত ছিল। এখন সরকারপ্রধানের যদি এমন বক্তব্য থাকে, তাহলে গোটা জাতি তো ভীত এবং স্তম্ভিত। জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলো। নির্বাচন নিয়েও কারও দ্বিমত নেই। দেশে নির্বাচনি একটা আবহও তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ওনার নিজের মুখ থেকে, যে কোনো মুহূর্তে হামলা আসতে পারে, বড় শক্তি, ছোট শক্তি নয়, যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে-এই ধরনের কথাবার্তার সারাংশ বা সারমর্ম তো খুব ভীতিকর। সাধারণ মানুষের জন্য তো এটা আতঙ্কের বিষয়। নির্বাচনের আগে আতঙ্ক তৈরি করে নির্বাচন পেছানো বা আগের মতো আরেকটা নির্বাচন করার অপচেষ্টা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশটাকে ঘোলাটে করার জন্য ওনার বক্তব্যই যথেষ্ট। নতুন করে আর কারও কিছু করার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কথার ব্যাখ্যা তিনিই ভালো দিতে পারবেন। এটা অন্যের দেওয়া ঠিক হবে না। ওনার কথার ব্যাখ্যা তো উনি দেবেন। তবে আমার মনে হয়, জুলাই সনদ, আরপিও-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, গণভোটের সময় নিয়ে তো ঐকমত্য হয়নি। ফলে এই দু-তিনটা ক্রিটিক্যাল জায়গায় তো সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কারণে তিনি হয়তো বিচলিত। এসব ধারণা থেকে তিনি হয়তো বলছেন, নির্বাচনের ওপর হামলা আসতে পারে। নির্বাচন কঠিন হতে পারে। আবার প্রকৃত ব্যাখ্যা এটা নাও হতে পারে। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং দলের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব বৃহস্পতিবার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে সংশয়-সন্দেহের কথা বলেছেন, বাস্তবে এর কিছু উপাদান আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই যেমন হঠাৎ করে বিভিন্ন জায়গায় আগুন, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটছে। তবে সরকারপ্রধানের কাছ থেকে আমরা আরও সুনির্দিষ্ট এবং তথ্যভিত্তিক বক্তব্য আশা করি। একই সঙ্গে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা তিনি এসব নিরাপত্তা হুমকি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করবেন। দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন তিনি।